নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে আগুন লেগে কভিড-১৯ ইউনিটের পাঁচ রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত চার পরিবারকে ১৫ দিনের মধ্যে ৩০ লাখ টাকা করে দেয়ার যে আদেশ হাইকোর্ট দিয়েছিলেন, তা স্থগিত হয়ে গেছে। গতকাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আবেদনের ওপর শুনানির পর আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারক মো. নূরুজ্জামান আট সপ্তাহের জন্য হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে দেন।
আদালতে ইউনাইটেড হাসপাতালের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান খান। রিটকারী পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী অনীক আর হক, হাসান এমএস আজিম, মুনতাসির উদ্দিন আহমেদ, নিয়াজ মোহাম্মদ মাহবুব, শাহিদা সুলতানা শীলা ও রাকিব হাসান।
পরে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা করে দিতে হাইকোর্ট কদিন আগে যে আদেশ দিয়েছিলেন, তার কার্যকারিতা আপাতত আট সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে দিয়েছেন চেম্বার আদালত।
ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোন যুক্তিতে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়েছে জানতে চাইলে এ আইনজীবী বলেন, ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রশ্নে হাইকোর্ট একটি রুল জারি করেছেন, যে রুলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। জানতে চাওয়া হয়েছে কেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ১৫ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেয়া হবে না। আমাদের মূল কথা হচ্ছে, যেহেতু রুল জারি হয়েছে, এর চ‚ড়ান্ত শুনানির পর একটি সিদ্ধান্ত হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না রুলের পূর্ণাঙ্গ শুনানি হচ্ছে, তার আগেই আমাকে ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হলো, তাহলে তো পক্ষান্তরে তো রুলটিই যথাযথ হয়ে গেল।
হাসপাতালের পক্ষের আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান খান বলেন, এটা জনস্বার্থের কোনো মামলা নয়। যারা আবেদনকারী তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য। প্রশ্ন হচ্ছে, একটা বেসরকারি পক্ষ আরেকটি বেসরকারি পক্ষের বিরুদ্ধে রিট করার এখতিয়ার রাখে কি না। এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য আছে। তাছাড়া এ ঘটনায় প্রকৃতপক্ষে ইউনাইটেড হাসপাতালের দায় আছে কি না, সেটা সাক্ষ্য-প্রমাণের বিষয়। রিটে এই বিষয়টির নিরসন সম্ভব নয়। তার জন্য নিম্ন আদালতে মামলা করতে হবে। ‘ফ্যাটাল অ্যাকসিডেন্ট অ্যাক্ট, ১৮৫৫’ অনুযায়ী দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু যদি হয়, তাহলে সেই মৃত্যুতে যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তারা ক্ষতিপূরণের মামলা অবশ্যই করতে পারবেন। তার জন্য নিম্ন আদালতে দেওয়ানি মামলা করতে হবে।
হাইকোর্টের আদেশের অনুলিপি পেলে নিয়মিত লিভ টু আপিল করা হবে বলেও জানান ইউনাইটেড হাসপাতালের আইনজীবী।
গত বছরের ২৭ মে রাতে গুলশানের বেসরকারি ওই হাসপাতালের প্রাঙ্গণে কভিড-১৯ রোগীদের জন্য করা আইসোলেশন ইউনিটে আগুন লেগে পাঁচ রোগীর মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে তিনজনের কভিড-১৯ পজিটিভ ছিল। ওই ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও গাফিলতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে কমিটি গঠন এবং নিহতদের পরিবারকে পাঁচ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশনা চেয়ে গত ৩০ মে একটি রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নিয়াজ মাহবুব ও শাহিদা শিলা।
আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া মাহবুব এলাহী চৌধুরীর ছেলে আননান চৌধুরী এবং ভারনন অ্যান্থনি পলের ছেলে আন্দ্রে ডোমিনিক পলও পরে সে রিট আবেদনে অন্তর্ভুক্ত হন। এরপর নিহত রিয়াজুল আলমের স্ত্রী ফৌজিয়া আক্তার ১৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে আলাদা একটি রিট আবেদন করেন। তাতে এক কোটি টাকা অন্তর্বর্তীকালীন ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়।
তার আগে এ ঘটনার বিচারিক তদন্ত চেয়ে গত বছর ১ জুন আরও দুটি রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী রেদওয়ান আহমেদ ও হামিদুল মিসবাহ। এরপর ২ জুন এসব আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ১৪ জুনের মধ্যে ঘটনার প্রতিবেদন দিতে বলেন হাইকোর্ট। এর মধ্যে পুলিশের দেয়া প্রতিবেদনে ইউনাইটেড হাসপাতালের গাফিলতির কথা আসে।
রাজউক জানায়, কভিড-১৯ রোগীদের জন্য আলাদা করে আইসোলেশন ইউনিট করার অনুমতি নেয়নি ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ।
ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনে বলা হয়, অগ্নিকাণ্ডের সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ নিলে রোগীদের মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হতো। তাছাড়া হাসপাতালের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। অন্যদিকে ইউনাইটেড হাসপাতালের প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ডের ওই ঘটনাকে ‘স্রেফ দুর্ঘটনা’ বলা হয়।
ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পর গত বছর ২৯ জুন এক আদেশে হাইকোর্ট ইউনাইটেড হাসপাতালকে ১২ জুলাইয়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করতে বলেন। সেইসঙ্গে ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে করা মামলাটির তদন্তও দ্রুত শেষ করতে নির্দেশ দেয়া হয়।
সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে এ ঘটনায় ক্ষতিপূরণ ও বিচারিক তদন্ত চেয়ে করা তিনটি রিট আবেদন বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের বেঞ্চে উপস্থাপন করা হলে গত ১১ জানুয়ারি আদালত রুলসহ আদেশ দেন। সে আদেশে ক্ষতিগ্রস্ত চার পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ৩০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেয়া হয়।