আধুনিক যুগে বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা বলে শেষ করা যাবে না। বিদ্যুৎ ও উন্নয়ন এখন প্রায় সমার্থক। অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রাপ্তির বিকল্প নেই। বিদ্যুতে দেশ যখন স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন গতকালের শেয়ার বিজে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন আমাদের হতাশ করবে। ‘কয়লা সংকট কাটেনি: বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতার দুই-তৃতীয়াংশই বন্ধ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ৫২৫ মেগাওয়াট। তবে গত কয়েকদিন ধরে কেন্দ্রটিতে উৎপাদন হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কারণ বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদামতো কয়লা সরবরাহ করতে পারছে না খনি কর্তৃপক্ষ। এছাড়া কয়লা আমদানির সিদ্ধান্ত নিলেও বেশকিছু জটিলতা রয়ে গেছে। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লার সংকট কাটেনি। এতে সক্ষমতার দুই-তৃতীয়াংশ উৎপাদনও বন্ধ থাকছে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের।
প্রসঙ্গত, কয়লা সংকটে ২২ জুলাই বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৪ সেপ্টেম্বর আবার তা চালু করা হয়। তবে এক মাস পেরুলেও এখনও পূর্ণমাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৫২৫ মেগাওয়াটের তিনটি ইউনিট রয়েছে। এজন্য প্রতিদিন কয়লা প্রয়োজন সাড়ে পাঁচ হাজার টন। কিন্তু খনি কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের উৎপাদন হচ্ছে দুই থেকে তিন হাজার টন। এদিকে দেশে কয়লা খালাসের জন্য কোনো বন্দরেই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই। কয়লায় ডাস্ট থাকায় আলাদা খালাসের ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়। একই জায়গায় অন্য পণ্যের সঙ্গে কয়লা খালাস করা যায় না। এজন্য পৃথক জেটিও দরকার। এছাড়া কয়লা পরিবহনে দেশে রেলওয়ের কোনো ওয়াগন নেই। আর ট্রাকে করে অধিক পরিমাণ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত বহন করা সম্ভব নয়।
পিডিবির তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী আবদুল হাকিম বলেন, ‘১১ হাজার টন কয়লার মজুদ নিয়ে আবার বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করা হয়। ২৭৫ মেগাওয়াটের এক ইউনিট চালাতেই দৈনিক দুই হাজার ৮০০ টন কয়লা দরকার। কিন্তু বড়পুকুরিয়া খনি পর্যাপ্ত কয়লা দিতে পারছে না। এতে কোনোভাবেই পূর্ণমাত্রায় ৫২৫ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব নয়।’
গত বছরের শেষদিকে চালু হয় বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের তৃতীয় ইউনিট। সে সময় বলা হয়েছিল, ২৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এ ইউনিটে দেশীয় কয়লা পুড়িয়েই উৎপাদন করা হবে বিদ্যুৎ। কয়লানির্ভর এ ইউনিট থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ মিলবে; পাশাপাশি উত্তরবঙ্গে সেচ খাতে বিদ্যুৎ সংকটও কমে আসবে। প্রতিষ্ঠাকালে জানানো হয়, ঘণ্টায় বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রটি থেকে উৎপাদন করতে পোড়াতে হবে ২ হাজার ৮০০ টন কয়লা। জোগান ঠিক থাকলে ৩০ বছর পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব এ কেন্দ্রটি থেকে। অথচ কয়লার অভাবে একটি ইউনিটেই পূর্ণ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। মোট ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রই রংপুর বিভাগের আট জেলায় এ চাহিদা মেটানোর প্রধান উপায়। তাই চলতি মাসের শুরু থেকে যখন দুই ধাপে ১২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ইউনিট বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন থেকেই সংকটে পড়ে এ অঞ্চলের মানুষ। সর্বশেষ ২৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন যে ইউনিটটি আংশিকভাবে চালু রেখে এ অঞ্চলের বিদ্যুৎ চাহিদা কোনোমতে সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলছিল, তাও বন্ধ করে দিতে হয়েছে খনিতে কয়লা মজুদ শেষ হয়ে যাওয়ায়। এতে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ বিদ্যুৎসেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে দাবি, ঘরে ঘরে আলো জ্বলা সময়ের ব্যাপার। দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষই বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বাকি মানুষের বিদ্যুৎ সংযোগ প্রাপ্তির লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। দেশজুড়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, আতশবাজি, আকাশে গুলি ছুড়ে সাড়ম্বরে পালিত হয়েছে জাতীয় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সপ্তাহ। এর পাশাপাশি বড়পুকুরিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদনক্ষমতার মাত্র ৩০ শতাংশ অর্জিত হচ্ছে এটি কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। আমরা চাই, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পূর্ণ উৎপাদন নিশ্চিত করতে শিগগির কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।