নিজস্ব প্রতিবেদক: দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে উত্তোলন করা কয়লার মধ্য থেকে এক লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা উধাও হয়ে যাওয়ার দুর্নীতির অনুসন্ধানে কমিটি গঠন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের উপ-পরিচালক শামসুল আলমের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন সহকারী পরিচালক এএসএম সাজ্জাদ হোসেন ও উপ-সহকারী পরিচালক এএসএম তাজুল ইসলাম। আর দুদক পরিচালক কাজী শফিকুল আলমকে এই অনুসন্ধান কাজের তদারকি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গতকাল এ কমিটি গঠন করা হয়। দুদকের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য এ তথ্য জানিয়েছেন। এরই মধ্যে দুদকের তদন্ত দল কয়লা গায়েবের প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
অপরদিকে কয়লা উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধানের ঘোষণা দেওয়ার পর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা সাংবাদিকদের জানান। কয়লা উধাওয়ের ঘটনায় মামলা করার জন্যও ইতোমধ্যে পেট্রোবাংলাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী। এ নিয়ে আলোচনার মধ্যে গতকাল সোমবার ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জাতীয় পাবলিক সার্ভিস দিবস উদযাপন ও জনপ্রশাসন পদক বিতরণ অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ে তার কার্যালয়ে যান। সেখানে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী, সংশ্লিষ্ট সচিব, পিডিবি ও পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করেন তিনি।
দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য জানান, দুদক আইন অনুযায়ী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে অনুসন্ধান শেষ করে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। খনির কোল ইয়ার্ড থেকে কয়লা উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির শীর্ষ পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ক্ষমতার অপব্যবহার, জালিয়াতি এবং বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে এক লাখ ১৬ হাজার টন কয়লা খোলা বাজারে বিক্রি করার মাধ্যমে আনুমানিক ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবীব উদ্দিন আহমদ ও অন্যদের বিরুদ্ধে। কয়লা সরবরাহ না পাওয়ায় বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন গত রোববার রাতে বন্ধ হয়ে গেছে। ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ওই কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ থাকায় রংপুর বিভাগের আট জেলা বিদ্যুৎ সংকটে পড়ায় বিকল্প পথ খুঁজছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নে নসরুল হামিদ বলেন, ‘তিনি (প্রধানমন্ত্রী) পূর্ণ তদন্ত করতে বলেছেন, কারণ ঘটনাটা হয়ে আসছে প্রায় ২০০৫ সাল থেকে। আমরা পুরোটা কাজে নেমেছি। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টাই বলেছেন যে, সবাইকে জানান দেওয়া, আগে থেকে সবার প্রস্তুতি নেওয়া, সবাই যেন ধৈর্য ধরে।’ প্রধানমন্ত্রী কি এ ঘটনায় ক্ষুব্ধÑএক সাংবাদিকের প্রশ্নে তিনি বলেন, অবশ্যই, তিনি তো আমার মন্ত্রী, এই বিভাগের মন্ত্রী। প্রতিমন্ত্রীর আগে পিডিবির চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ বিদ্যুৎ ভবনে সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মানুষের যেন ভোগান্তি কম হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। তিনি বলেন, দু’মাস আগে থেকেই বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বলা হচ্ছিল যে, আমাদের কয়লার সংকট চলছে, কিন্তু ওখানকার যে প্রধান প্রকৌশলী তিনি বলছিলেন, না কোনো সংকট নেই। তখন বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে তদন্ত দল পাঠানোর পর তথ্যটা উদ্ঘাটিত হলো।
এদিকে ঘটনা তদন্তে পেট্রোবাংলার পরিচালক কামরুজ্জামানকে প্রধান করে শুক্রবার তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ তদন্ত প্রতিবেদন মঙ্গলবারের মধ্যে পাওয়া যাবে বলে জানিয়ে নসরুল হামিদ বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদনে জানতে চাচ্ছি, কয়লার অস্তিত্বটা কোথায়?’ দোষীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবেÑজানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে কেস করার জন্য। তদন্ত চলবে। শাস্তি পাবে। এটা তো এক দিনে হয়নি। এটা বহু দিনের ব্যাপার। অনেকে বলছেন, ২০০৫ সাল থেকে। পেছনের দিকে যেসব ব্যক্তি আছেন আমরা তাদেরও তদন্ত করে দেখতে চাই। তাদের সময়কার অবস্থাটা কী ছিল?’ পেট্রোবাংলার তদারকিতে কোনো সমস্যা ছিল কি নাÑজানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমি বলব, অবশ্যই সমস্যা ছিল। পেট্রোবাংলার অধীনের কোম্পানি, ওভারঅল তার মনিটিরং তো থাকতেই হবে।’
সূত্রমতে, দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে উত্তোলন করা কয়লার মধ্য থেকে এক লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা উধাও হয়ে গেছে। এ ঘটনায় খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহম্মদ ও খনির সচিব (মহাব্যবস্থাপক, প্রশাসন) আবুল কাশেম প্রধানিয়াকে প্রত্যাহার করেছে পেট্রোবাংলা। একই কারণে খনি বিভাগের জিএম নুরুজ্জামান চৌধুরী ও ডিজিএম খালেদুলকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা) আইয়ুব আলী খান চৌধুরীকে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ আদেশ জারি করেন পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মাজেদুর রহমান।
খনি সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ সাল থেকে এ খনিতে কয়লা উত্তোলন শুরু হয়। নথিপত্র অনুযায়ী, এ পর্যন্ত খনি থেকে এক কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে। তবে এর মধ্য থেকে এক লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন কয়লার হদিস পাওয়া যায়নি। খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সচিব ও খনির মাইনিং বিভাগ এসব কয়লা বাইরে বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে গত ১৫ জুন থেকে খনিতে কয়লা উৎপাদন বন্ধ রয়েছে, কিন্তু খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সচিব ও খনির মাইনিং বিভাগ তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা মজুদ না রেখে বাইরে কয়লা বিক্রি করেছেন। এ কারণে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পেট্রোবাংলা কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের নির্দেশে তিনি এ আদেশ জারি করেছেন।

Print Date & Time : 26 June 2025 Thursday 1:55 pm
কয়লা গায়েবের প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে দুদক
পত্রিকা,প্রথম পাতা ♦ প্রকাশ: