খাদ্যদ্রব্যের মজুত বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে

ফুয়াদ হাসান: বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি ছন্নছাড়া, যার ফলে ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বেকারত্ব এবং কমছে মানুষের দৈনন্দিন আয়। চলতি বছরেই কর্মসংস্থান হারিয়েছে লাখ লাখ মানুষ। প্রায় তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে, মোট জনসংখ্যার অর্ধেক দরিদ্র অবস্থায় রয়েছে। বিবিএসের তথ্যমতে, করোনার প্রথম পাঁচ মাসে দেশে পরিবারপিছু মাসিক আয় হ্রাস পেয়েছে প্রায় চার হাজার টাকা করে। ফলে অনেক মানুষ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে সরকারি ত্রাণ সহায়তার ওপর। এতে খাদ্যশস্যের মজুতে টান পড়েছে। সম্প্রতি দৈনিক কাগজে প্রকাশিত তথ্য বলছে, দেশে খাদ্যশস্যের মোট মজুতের পরিমাণ ১১ লাখ ৯৫ হাজার ৮০০ টন। এর মধ্যে চাল রয়েছে আট লাখ ৮৩ হাজার ৮৬০ টন এবং গম তিন লাখ ১১ হাজার ৯৪০ টন। গত বছরের একই সময়ে দেশে খাদ্যশস্যের মোট মজুত ছিল ১৭ লাখ ২০ হাজার ৩২০ টন, অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খাদ্যশস্যের মজুত হ্রাস পেয়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। এদিকে চলতি বছরের ৯ সেপ্টেম্বর সরকারি গুদামগুলোয় মোট খাদ্যশস্য মজুতের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ১৯ হাজার টন। সে হিসেবে এক মাসের ব্যবধানে দেশে খাদ্যশস্যের মজুত হ্রাস পেয়েছে ১৬ শতাংশের কাছাকাছি।

আসন্ন শীতে মহামারির আরেক দফা ঢেউ বয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বিজ্ঞানীরা। এরই মধ্যে ইউরোপের ওপর দিয়ে দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ ঢেউ বয়ে গেছে। বাংলাদেশেও সামনের শীতে আরেকটি বড় সংক্রমণের ঢেউ বয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশই নয়, এ আশঙ্কায় রয়েছে বিশ্বের অন্যান্য দেশও। কভিড-১৯ মহামারি-সৃষ্ট অনিশ্চয়তাপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি হিসেবে বিশ্বের অনেক দেশেই খাদ্যের উৎপাদন ও মজুত বাড়িয়ে তোলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশ্ববাজার থেকে সবচেয়ে বেশি গম কেনে মিসর। এপ্রিলের পর থেকে মিসর গম আমদানি বাড়িয়েছে ৫০ ভাগ। গম আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক তুলে নিয়েছে মরক্ক। অন্যদিকে রেকর্ড পরিমাণ গমের মজুত গড়ে তুলেছে জর্ডান। এদিকে গমের পাশাপাশি চিনি ক্রয় বাড়িয়েছে পাকিস্তান। তাইওয়ান জানিয়েছে খাদ্য মজুত বাড়ানোর পরিকল্পনার কথা। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে খাদ্য আমদানি কার্যক্রম গতিশীল করেছে বিশ্বের জনবহুল দেশ চীন। মহামারির কথা মাথায় রেখে দেশগুলোর এমন মনোভাব বিশ্ব খাদ্যবাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশগুলোর আগ্রাসী মনোভাব এটাই প্রমাণ করে যে, তারা সম্ভাব্য মন্দা পরিস্থিতি থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে কতটা মরিয়া। জাতিসংঘের অধীন খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ আব্দুলরেজা আব্বাসিয়ান বলেছেন, করোনা মহামারি সাপ্লাই চেইনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, এমন আশঙ্কায় কিছু দেশ আগে থেকেই খাদ্যপণ্যের ক্রয় বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্যাংক অব আমেরিকার বিশ্লেষকরা বলেছেন, কভিড-১৯ মহামারির কারণে ক্রেতারা এখন ‘জাস্ট-ইন-টাইম ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট’-এর পরিবর্তে ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের জন্য মজুত রাখার নীতি গ্রহণ করেছেন। ফলে ভবিষ্যৎ সরবরাহ সংকটের আশঙ্কায় তারা অনেক বেশি পণ্য মজুত করে রাখছেন। করোনার কারণে বৈশ্বিক খাদ্যবাজারে অস্থিরতা দেখা দেওয়ার আভাস আগেই দিয়েছিল এফএও, সেটি এখন বাস্তবে রূপলাভ করতে যাচ্ছে। যেমনÑকাজাখস্তান এরই মধ্যে গমের আটা রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে এবং শাকসবজি রপ্তানির ওপর সীমা আরোপ করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গম রপ্তানিকারক রাশিয়া পণ্যটির রপ্তানিতে সীমা আরোপ করতে পারে। বৈশ্বিক চাল রপ্তানিতে শীর্ষ দেশ ভারত লকডাউনে চলে গেছে। ফলে ভারত থেকে পণ্যটির সরবরাহ চ্যানেল এখন থমকে দাঁড়িয়েছে। ভিয়েতনাম চাল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। একই পথে হাঁটতে পারে থাইল্যান্ডও। রপ্তানি সীমাবদ্ধতার কারণে বাড়ছে চালের দাম। রাশিয়ার ভেজিটেবল অয়েল ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে সূর্যমুখীর বীজ রপ্তানিতে সীমা আরোপের আহ্বান জানানো হয়েছে। পাম অয়েলের দ্বিতীয় শীর্ষ উৎপাদনকারী দেশ মালয়েশিয়ায় পণ্যটি উৎপাদনের গতিও এখন বেশ শ্লথ হয়ে এসেছে। বিপরীতে আমদানিকারক দেশগুলোয় খাদ্যপণ্যের চাহিদাও এখন বাড়তির দিকে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমদানি চাহিদা বাড়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যের মূল্যসূচকও এখন ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সেপ্টেম্বরেও টানা চতুর্থ মাসের মতো ঊর্ধ্বমুখিতায় ছিল বৈশ্বিক খাদ্যমূল্য সূচক। ওই সময় বৈশ্বিক গড় খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে দুই শতাংশেরও বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) মতে, বিশ্বব্যাপী খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে খাদ্যনিরাপত্তা হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি জনসাধারণের জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ বেশ ব্যয়বহুল হয়ে পড়তে পারে। কারণ বিশ্বের দেশে দেশে অর্থনীতিতে ধস নামানোর পাশাপাশি কর্মহীনতাও বাড়িয়েছে মহামারির প্রাদুর্ভাব। এদিকে বাংলাদেশ সরকারি মজুত বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা থেকে চলতি বছর বোরো মৌসুমে মোট আট লাখ টন ধান সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছিল। এর বিপরীতে সংগ্রহ হয়েছে দুই লাখ ১৯ হাজার ৮৬৫ টন। এছাড়া চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল সাড়ে ১১ লাখ টন। এর বিপরীতে সিদ্ধ ও আতপ চাল সংগ্রহ হয়েছে যথাক্রমে ছয় লাখ ৬৭ হাজার ৮৯০ ও ৯৯ হাজার ১২৩ টন। আসন্ন শীতে মহামারি তুঙ্গে উঠতে পারে। আর যদি শঙ্কাটাই সত্য হয়, তাহলে মজুত খাদ্যদ্রব্যের চাহিদাও বৃদ্ধি পাবে। এ অবস্থায় সতর্ক থাকাই শ্রেয়। তাছাড়া সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে খাদ্যের বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে। এমনিতেই দীর্ঘ মহামারি ও সিরিজ বন্যার মাঝে অসহায় ও নিম্ন আয়ের মানুষগুলো পেঁয়াজ সমাচার ও আলুর তাণ্ডব ভুলতে পারছে না। তাই সরকারের যথেষ্ট মজুত থাকলে অনাকাক্সিক্ষত বাজার পরিস্থিতি ও মহামারির অনিশ্চিত সংকট মোকাবিলা করা তুলনামূলকভাবে সহজ হবে। মোদ্দা কথা, বিশ্ববাজারে খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা, বিভিন্ন রাষ্ট্রের দূরদর্শী পরিকল্পনা ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিয়তার কথা বিবেচনা করে সুধীজনেরা খাদ্যদ্রব্যের মজুত বাড়ানোর যে পরামর্শ দিচ্ছেন, আামাদের সে পথে এগোনোই সমীচীন।

শিক্ষার্থী

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০