এস এম নাজের হোসাইন: সরকারের নানামুখী কর্মকাণ্ডে দেশ খাদ্য উৎপাদনে অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও এখনও সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। দেশে খাদ্য ব্যবসায় জড়িত কিছু অতি মুনাফালোভী ও ভেজালকারী চক্রের দৌরাত্ম্য ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ও খাদ্যপণ্যের বাজারে ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া আধিপত্যের কারণে দেশে ন্যায্য ব্যবসার পরিবেশ যেমন বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনই ব্যবসা-বাণিজ্যে সুশাসনের ঘাটতিও ক্রমাগতভাবেই বাড়ছে। নিরাপদ খাদ্যের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ এখনও পুরোপুরি সচেতন নয়, যার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত রাজধানীসহ বড় বড় শহরে রাস্তার ওপর ধুলা-ময়লায় ভরা পথ-খাবার বিক্রি ও ক্রেতাদের দীর্ঘ সারির লাইন। কৃষক ও উৎপাদকের মাঠ/খামার থেকে, পরিবহন, সংরক্ষণ, বিপণন ও খাবার টেবিলে পরিবেশন পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করার বিধিবিধানগুলো পুরোপুরি অনুসরণ করা না হলে নিরাপদ খাদ্যও অনিরাপদ হয়ে যেতে পারে। সরকার ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে উদ্যোগ নিচ্ছে, কিন্তু এই মধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে স্বাস্থ্যবান কর্মক্ষম জনশক্তির বিকল্প নেই। আর কর্মক্ষম জনশক্তির জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাবারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। খাদ্যে পুষ্টির মান নিশ্চিত না হলে কর্মক্ষম জনশক্তি পাওয়া দুরূহ হবে। তবে আশার কথা হচ্ছে, সরকার এখন এ বিষয়ে মনোযোগ দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী খাদ্যে ভেজাল ও অনিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও বিক্রয়কে ‘দুর্নীতি’ হিসেবে চিহ্নিত করে এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। সম্প্রতি হাইকোর্টও খাদ্য ভেজালকে দুর্নীতি বলে আখ্যা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। সরকার এ ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করবে। প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণায় দেশে নিরাপদ খাদ্যের আন্দোলন বেগবান হবে। নাগরিক হিসেবে আমরা বেশ স্বস্তিবোধ করছি।
প্রতিনিয়তই বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বলছে, রাস্তার খাবার থেকে প্যাকেটজাত পণ্য সবকিছুতেই মেশানো হচ্ছে নানা রকম ক্ষতিকর কেমিক্যাল। বিদেশ থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ গুঁড়োদুধ আমদানি ছাড়াও গুঁড়োদুধে সিসা এবং মার্কারি, মুরগির মাংসে হেভি মেটাল এবং গরুর মাংসে পাওয়া যাচ্ছে গরু মোটাতাজাকরণের স্টেরয়েড। মিষ্টান্ন ও বেকারিতে তৈরি পাউরুটিতে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্যানসারের জন্য দায়ী পটাশিয়াম রোমেটসহ নানা কেমিক্যাল। হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রান্না, পরিবেশন ও সংরক্ষণ করা এবং পোড়া তেল ও মানহীন উপাদান দিয়ে খাদ্য রান্নার অভিযোগ প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। এছাড়া ফুডগ্রেড দেওয়ার পরিবর্তে কাপড়ের রং ও দেয়ালের রং ব্যবহারের ভয়াবহ চিত্র প্রতিনিয়তই খররের শিরোনাম হচ্ছে। খাদ্যে ভেজালের এই সীমানা এখন আর খাদ্যপণ্যে সীমিত নেই, এটি জীবনরক্ষাকারী ওষুধ ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাবেও সংক্রমিত হয়েছে, যার কারণে মধ্যবিত্তসহ সাধারণ মানুষ যা আয় করে, তার সিংহভাগই এখন চিকিৎসা ও ওষুধ ক্রয়ে চলে যায়। দীর্ঘদিন থেকেই অনিরাপদ খাদ্যের কারবারিরা তৎপর থাকলেও তাদের অপতৎপরতা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপের অভাব রয়েছে। নানা সময়ে তাদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদফতর ও বিএসটিআই’র অভিযান পরিচালিত হলেও কার্যত কাক্সিক্ষত ফল আসেনি। একই প্রতিষ্ঠানকে বারবার জরিমানা করার পরও পরবর্তী সময়ে আবারও একই অপরাধ পাওয়া যাচ্ছে। অভিযান বন্ধ হলেই ভেজাল কারবারিরা বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। এখন তাদের দৌরাত্ম্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। উল্লেখ্য, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার মানসে সরকার ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ প্রণয়ন করেছে এবং আইনের আওতায় আলাদাভাবে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠন করেছে। জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করেছে। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সেনিটারি ইন্সপেক্টরদের নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক পদে পদায়ন করা হয়েছে। এরই মধ্যে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বেশ কয়েকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, জনবল সংকটের কারণে প্র্রতিষ্ঠানটি জনগণের চাহিদামাফিক সব কার্যক্রম সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পারছে না। আবার কিছু জায়গায় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ১৭টি মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের সমন্বয়হীনতা, দায়িত্বপালনে গাফিলতি ও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও আছে। আর এর সুযোগ নিচ্ছে অনিরাপদ খাদ্যের কারবারিরা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের সাধারণ ভোক্তাসাধারণ। খাদ্যে ভেজালকারী ও মুনাফাশিকারি সিন্ডিকেটগুলো একদিকে নানাভাবে পণ্যের দাম বাড়িয়ে জনগণের পকেট কাটছে, অন্যদিকে অনিরাপদ ভেজালপণ্য বিক্রি করে সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্যহানি করছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, খাদ্যপণ্যে এই নৈরাজ্য ঠেকাতে জেলা প্রশাসন, খাদ্য অধিদফতর, জাতীয় ভোক্তা অধিদফতর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, প্রাণিসম্পদ অধিদফতর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তাদের মধ্যে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সমন্বয় জোরদার করতে হবে। একই সঙ্গে নিরাপদ খাদ্যের মূল অংশীজন হলো ভোক্তা। সরকারি নীতিনির্ধারণে এই ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মাঝে বৈষম্য হ্রাস করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নীতিনির্ধারণীতে ব্যবসায়ীদের আধিক্য থাকলেও ভোক্তাদের প্রতিনিধিত্ব আমলে নেওয়া হয়নি। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দফতরগুলো সব সময় ব্যবসায়ীদের সক্ষমতা উন্নয়নে নানা কর্মসূচি নিলেও ভোক্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও তাদের সংগঠনকে শক্তিশালী করতে আগ্রহী নয়। ফলে ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যবধান বেড়েই চলেছে। কর্তৃপক্ষ যদি ব্যবসায়ীনির্ভর হয়ে যায়, তাহলে যাবতীয় নীতি প্রণীত হবে ব্যবসায়ীদের স্বার্থে, যা খাদ্যপণ্যের বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বড় অন্তরায় হবে এবং চলমান ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের বৈষম্যকে আরও উসকে দেবে।
সুস্থ-সবল জাতিগঠন ও জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যসম্মত পুষ্টিকর খাবারের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই সুস্থ জাতি ও কর্মক্ষম জনশক্তি গড়ে তুলতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজš§কে সুস্থ রাখতে নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। দেশে নিরাপদ খাদ্য, ভোক্তা অধিকারসহ জনস্বার্থে অনেক আইন, বিধিবিধান ও কর্তৃপক্ষ থাকলেও আইন প্রয়োগ সব সময় যথাযথভাবে হয় না। আইন প্রয়োগে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে প্রয়োগের মাত্রাগুলোও রং বদলায়। সে কারণে আইন না মানার সংস্কৃতি ক্রমেই বাড়ছে। সরকারদলীয় সংশ্লিষ্টতা এবং প্রভাবশালী ও বড় ব্যবসায়ীদের বেলায় শিথিলতার কারণে আইন প্রয়োগ বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আবার সরকারের বিভিন্ন দফতর ও বিভাগের সঙ্গে কার্যকর আন্তঃসমন্বয় না হওয়ার কারণেও আইনের প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তারপরও আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে ব্যাপক জনসচেতনতাও গড়ে তুলতে হবে, কারণ মানুষ নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে খাদ্যপণ্য কিনে থাকে। কেনার আগে খাদ্যপণ্যটির মান যাচাই করা একান্ত আবশ্যক। শুধু বাহারি ও চটকদার বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হয়ে খাদ্যপণ্য কিনলে প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকছে। সতর্কতা অবলম্বনে জনগণের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে কৃষক ও উৎপাদনকারীদেরও সচেতন ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, খাদ্যদ্রব্যের প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাতকরণ, সরবরাহ ব্যবস্থা, সংরক্ষণসহ খাদ্যশৃঙ্খলের প্রতিটি ক্ষেত্র নিরাপদ রাখার যাবতীয় বিধিবিধান ও অনুসরণীয় বিষয়গুলোকে কঠোরভাবে মেনে চলতে ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। সেখানে ব্যত্যয় ঘটলে আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে সাধারণ জনগণ ও কোমলমতি শিশুদের মাঝে সচেতনতা বিকাশে গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিজ্ঞাপনের লোভে খাদ্যে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে প্রকৃত তথ্য ও সংবাদ প্রকাশে বাধা দেওয়া এবং ভেজালের পক্ষে সাফাই সংবাদ পরিবেশন থেকে বিরত থেকে জাতিকে প্রকৃত তথ্য জানাতে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। এছাড়া ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরিতে শিক্ষা একটি বড় ফ্যাক্টর। সেজন্য পাঠ্যসূচিতে জাঙ্ক ফুডের মতো অনিরাপদ খাদ্যপণ্যসহ ভোক্তা অধিকার সুরক্ষার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তাহলে আজকের প্রজন্ম বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তা হিসেবে তার অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞাত হতে পারবে। আর তাহলেই দায়িত্ববান জাতি যেমন পাওয়া যাবে, তেমনই স্বাস্থ্যসচেতন, সুস্থ-সবল ও কর্মক্ষম জনশক্তি পাওয়া সহজ হবে।
ভাইস প্রেসিডেন্ট
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
cabbd.nazer@gmail.com