খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে সচেতনতার বিকল্প নেই

মো. আরাফাত রহমান : অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য খাদ্যের সঙ্গে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য, নি¤œমানের খাদ্যসহ যেকোনো ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মেশানোই ভেজাল। প্রকৃতিগত ও গুণগত নির্ধারিত মানসম্মত না হলে যে কোনো খাদ্যদ্রব্যই ভেজালযুক্ত বিবেচিত হতে পারে। অসাধু ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার জন্য সাধারণত এ কাজ করে থাকে। ভেজাল দেয়ার প্রক্রিয়ায় খাদ্যশস্যে বহির্জাত পদার্থ সরাসরি যোগ করা হয়, যেমন ওজন বৃদ্ধির জন্য বালি বা কাঁকর, ভালো শস্যের সঙ্গে কীটপতঙ্গ-আক্রান্ত বা বিনষ্ট শস্য মেশানো প্রভৃতি। কেউ কেউ ধান ভানার সময় খুদ ও কুঁড়া যোগ করে ওজন বাড়ায়।

মাছ থেকে মাংস, দেশীয় ফল থেকে আমদানিকৃত ফল, শাকসবজি, জ্যাম-জেলি-আচার সব জিনিসেই ভেজাল রয়েছে। শিশুখাদ্য থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব খাদ্যপণ্যেই এই ভেজালের ছড়াছড়ি। যেমনÑমুড়ির রং অধিক সাদা করতে ব্যবহার করা হয় ইউরিয়া। পচন থেকে রক্ষা করতে মাছে দেয়া হয় ফরমালিন, দুধে মেশানো হয় মেলামিন। দীর্ঘক্ষণ সজীব ও আকর্ষণীয় রাখতে মিষ্টিতে ব্যবহার করা হয় রংবর্ধক কেমিক্যাল। বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয় ফল পাকাতে ও পচন রোধ করতে।

আম, কলাসহ অন্যান্য ফল দ্রুত পাকানো ও আকর্ষণীয় রঙের জন্য কার্বাইড এবং পচন রোধে ফরমালিন ব্যবহার করা হচ্ছে। মৃত মাছেও ফরমালিন মেশানো হচ্ছে। শুঁটকি মাছে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্ষতিকর ডিডিটি। শাকসবজিতেও ফরমালিন ও কীটনাশক দেয়া হচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ মচমচে রাখার জন্য জিলাপি ও চানাচুর তৈরিতে ব্যবহƒত হচ্ছে পোড়া মবিল। আকর্ষণীয় করার জন্য কাপড় ও চামড়ায় ব্যবহƒত রং ব্যবহার করা হচ্ছে আইসক্রিম, বিস্কুট, সেমাই, নুডলস, ফলের জুস এমনকি মিষ্টি তৈরিতে। আজকাল লবণেও ভেজাল হিসেবে মেশানো হচ্ছে বালি।

কমলা ও মাল্টার স্বাদ পরিবর্তিত হয়েছে রাসায়নিক পদার্থের কারণে। নকল, ভেজাল ও বিষাক্ত ওষুধ প্রকাশ্যে বিক্রি করা হচ্ছে। সরষের তেলে ঝাঁজ বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয় এক ধরনের কেমিক্যাল। মুরগির খাবারে ট্যানারির বর্জ্য, ভয়ংকর বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্যযুক্ত ভুসি ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে মুরগির মাংস ও ডিম বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। দেশের বিভিন্ন হোটেলে তরকারির রং আকর্ষণীয় করতে জর্দার রং ও বিভিন্ন রাসায়নিক রং ব্যবহার করা হচ্ছে। মরা মুরগি রান্না করা হচ্ছে। দুর্গন্ধ রোধে মরা মুরগির মাংস রান্না করার সময় লেবুর রস ব্যবহার করা হচ্ছে। শরবত, ঠাণ্ডা পানি ও লাচ্ছিতে ব্যবহার করা হচ্ছে মাছে ব্যবহƒত বরফ।

আজকাল দানাশস্যের সঙ্গে শস্যদানার আকারের প্লাস্টিকের ছোট ছোট টুকরা আর ডালের সঙ্গে রঙিন টুকরা মেশানো হয়। অনেক সময় মজুত খাদ্যশস্যের ওজন বাড়ানোর জন্য কেউ কেউ তাতে পানি ছিটায়। তেল ও চর্বিতে ভেজাল দেয়া খুবই সহজ এবং এগুলো শনাক্ত করাও দুরূহ। ঘিয়ের সঙ্গে পশুচর্বি দিয়ে ভেজাল দেয়া হয়ে থাকে। ইদানীং কৃত্রিম রং ও গন্ধদ্রব্য আবিষ্কারের ফলে চর্বি দিয়ে নকল ঘি বানিয়ে ভোক্তাদের সহজেই ঠকানো যায়। তিল বা নারিকেল তেলের সঙ্গে প্রায়ই বাদাম তেল বা তুলাবীজের তেল মেশানো হয়ে থাকে।

সরষের সঙ্গে প্রায়ই শিয়ালকাঁটার বীজ একত্রে মিশিয়ে তেল বের করা হয়। উল্লেখ্য, শিয়ালকাঁটার তেলের একটি উপক্ষার অত্যন্ত বিষাক্ত এবং তা পক্ষাঘাত ঘটায়। সয়াবিন তেল বা পাম তেলের সঙ্গে এলাইলআইসোথিওসায়ানেট মিশালে তাতে সরষের তেলের মতো ঝাঁঝ হয় এবং সহজেই সরষের তেল বলে চালিয়ে দেয়া যায়। সয়াবিন তেলের সঙ্গে পাম তেলের ভেজাল মেশানো অধিক মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ীদের একটি চিরাচরিত অপকর্ম। অনেক সময় দুধের মাখন তুলে নিয়ে অথবা দুধে পানি মিশিয়ে ভেজাল দুধ বাজারজাত করা হয়। কখনও কখনও সয়াবিন তেল বা বাদাম তেল, ময়দা ও অন্যান্য দ্রব্যাদি দুধে মেশানো হয়। মহিষের দুধ পানি দিয়ে পাতলা করে গরুর দুধ বলে সহজেই চালানো যায়। গুঁড়োদুধে ময়দা, সুজি ও অন্যান্য দ্রব্য মেশানো খুবই সহজ।

ব্যবহƒত চা পাতা, কাঠের গুঁড়া ও শুকনা পাতার গুঁড়া দিয়ে চায়ে ভেজাল দেয়া হয়। মসলার মধ্যে মরিচ বা হলুদ গুঁড়াতে সিসাজাতীয় রঞ্জক পদার্থ মিশিয়ে রঙের উজ্জ্বলতা বাড়ানো হয় এবং দেখতে ভালো দেখায়। মিষ্টিজাতীয় দ্রব্যাদি তৈরিতে ছানার পরিবর্তে বেশি বেশি চালের গুঁড়ো বা ময়দা মেশানো হয়। কোমল পানীয় তৈরিতে তরল গ্লুকোজ বা চিনির সিরাপের পরিবর্তে প্রায়ই ব্যবহƒত কার্বোক্সি মিথাইল সেলুলোজ মেশানো হয়। বিভিন্ন ফলের রসের নামে কৃত্রিম ও নিষিদ্ধ দ্রব্য ব্যবহার করে নকল রস তৈরি হয়ে থাকে। অধুনা মিনারেল ওয়াটার নামে বাজারে যে পানির ব্যবসা চলছে, তাতে গুণ ও মানের নিশ্চয়তা অতি সামান্য বা অনেক ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে।

খাদ্য ভেজালিকরণ উপাদানগুলো মানবদেহের নানা ক্ষতির কারণ। বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্যমিশ্রিত খাবার ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। মাছ, মাংস, ফল ও দুধে ফরমালিন প্রয়োগের ফলে ক্যানসার, হাঁপানি ও চর্মরোগ হয়। শিশু ও গর্ভবতী মায়ের জন্য এর ক্ষতিকর প্রভাব মারাত্মক। অতি অল্প পরিমাণ ফরমালডিহাইড গ্যাস ব্যবহারও ব্রঙ্কাইটিস ও নিউমোনিয়ার সংক্রমণের কারণ। ফরমালিন বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ, যা গ্রহণের ফলে মানুষের তাৎক্ষণিক মৃত্যুসহ মানবদেহে নানা ধরনের ক্যানসার হয়ে থাকে। যেগুলোর অধিকাংশ কারণই জানা যায়নি।

তবে ফরমালিনের মতো বিষাক্ত রাসায়নিক যে ক্যানসারের বিস্তারে সক্ষম তা প্রমাণিত। এর ফলে পাকস্থলীতে প্রদাহ, লিভারের ক্ষতি ও অস্থি-মজ্জা জমে যায়। ভোক্তা অধিকার সংগঠন বাংলাদেশ কনজুমার রাইটস সোসাইটির দেয়া তথ্যমতে, ভেজাল খাদ্য খেয়ে দেশে প্রতি বছর তিন লাখের বেশি মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রায় দেড় লাখ মানুষ ডায়াবেটিস ও দুই লাখ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কার্বাইডের কারণে তীব্র মাথাব্যথা, ঘূর্ণি রোগ ও প্রলাপ হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এটা মেজাজ খিটখিটে ও স্মরণশক্তির ক্ষতি করতে পারে। ক্যালসিয়াম কার্বাইডের ফলে কিডনি, লিভার, ত্বক, মূত্রথলি ও ফুসফুসে ক্যানসার হতে পারে।

ভেজাল প্রতিরোধে বাংলাদেশে অনেক আইন আছে। ভেজাল পণ্য উৎপাদন রোধে বিশুদ্ধ খাদ্য আইনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তির বিধান আছে। এছাড়া খাদ্যে ভেজাল ও রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো নিয়ে দণ্ডবিধি ১৮৬০, বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ ১৯৫৯, বিশুদ্ধ খাদ্য নীতিমালা ১৯৬৭, বিশুদ্ধ খাদ্য আইন (সংশোধিত) ২০০৫, ভ্রাম্যমাণ আদালত অধ্যাদেশ ২০০৯, পয়জনস অ্যাক্ট ১৯১৯, ভোক্তা অধিকার আইন ২০০৯-সহ আরও অনেক আইন রয়েছে। প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ ফরমালিনসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি করা হয়। কিন্তু সেগুলো কোথায় বিক্রি করা হয়, তার সুষ্ঠু হিসাব নেই। এসব রাসায়নিক দ্রব্য খোলা বাজারে বিক্রি করা হয়। আর সেগুলো প্রতিনিয়ত ব্যবহার করা হচ্ছে খাদ্যদ্রব্যে।

বাংলাদেশে ভেজাল দূর করতে হলে প্রথমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪’-এর ২৫(গ) ধারায় খাদ্যে ভেজালের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। অব্যবহƒত আইন ব্যবহার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে যদি শাস্তি নিশ্চিত করা হয়, তাহলে ভেজাল রোধ করা সম্ভব হবে। সরকারের নীতিনির্ধারণী ফোরামে বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক দ্রব্য আমদানির ওপর পর্যাপ্ত নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে আমদানিকৃত রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার যাতে সীমিত থাকে, সেজন্য নীতিমালা প্রণয়ন করে সেগুলো প্রয়োগ করতে হবে।

নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান জোরদার করতে হবে। ভেজালবিরোধীদের সামান্য জরিমানা করলে কাজ হবে না। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) কর্তৃপক্ষের উচিত পণ্যের মান নিশ্চিত করে অনুমোদন দেয়া। তাছাড়া বিএসটিআইএর কর্তৃপক্ষের কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত হলে তার ব্যবস্থা নেয়া উচিত। সরকারি পর্যায়ে আরও কিছু করণীয় কাজের মধ্যে রয়েছেÑক. দেশের বিদ্যমান আইনগুলোকে যুগোপযোগী ও আরও কঠিন শাস্তির বিধান এবং বাস্তবে তা প্রয়োগ নিশ্চিত করা; খ. খাদ্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা কঠোর করা; গ. উৎপাদন থেকে ভোক্তার হাত পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্য পৌঁছানোকে ক্রমাগত পরিদর্শনের আওতায় আনা; ঘ. বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর করা।

ব্যবসায়ীদের করণীয় কাজের মধ্যে রয়েছেÑক. অসৎ খাদ্য ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে; খ. অসাধু ব্যবসায়ীদের পক্ষে সমগ্র ব্যবসায়ী সমাজের এক হয়ে কথা বলা বন্ধ করতে হবে। ভোক্তা পর্যায়ে করণীয় কাজের মধ্যে রয়েছেÑক. ভোক্তাদের সংগঠিত হয়ে খাদ্যসন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে; খ. ভোক্তাদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে; গ. ভেজালযুক্ত খাদ্যদ্রব্য বয়কট করতে হবে।

সন্দেহাতীতভাবে খাদ্যে ভেজাল একটি জাতীয় সমস্যা ও জাতীয় বিপর্যয়, যা আমাদের সবাইকে বিশেষ করে নীতিনির্ধারকদের সর্বাগ্রে সত্যিকারভাবে অনুধাবন করতে হবে। সুস্থ থাকার জন্য ভেজালমুক্ত খাবারের বিকল্প নেই। কিছু অসৎ ব্যবসায়ী ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার্থে সমাজকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। ভেজাল খাদ্য জাতিকে ঠেলে দিচ্ছে পঙ্গুত্বের দিকে। দেশ ও জাতির সত্যিকার অর্থে উন্নতি চাইলে অসৎ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং ভেজালমুক্ত খাবার নিশ্চিত করতে হবে।

সহকারী কর্মকর্তা

ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট

সার্ভিসেস বিভাগ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০