খাদ্য অপচয় ও আমাদের দায়

সামিহা খাতুন: সভ্যতার চরম উৎকর্ষের এ যুগেও পৃথিবীর ৪০ শতাংশ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের চারপাশে কেবল অভাব-অনটন, ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও নানা সমস্যার পাহাড়। ধনতান্ত্রিক সভ্যতার তৈরি করা কৃত্রিম সংকট মানুষের মুখ থেকে কেড়ে নিয়েছে অন্ন। ক্ষুধা নিবারণের জন্য এক বেলা খাবার যেন একটি ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে কাম্য। জীবন-জীবিকার সমস্যায় আচ্ছন্ন হাতে এক বেলার খাবার জোগাড় করতে পারলেই যেন ক্ষুধানিবৃত্তি হয়। অন্ন দে মা অন্নদাÑবলে আকুল কান্নায় কেঁদেছিলেন রামপ্রসাদ। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, দারিদ্র্য অসহ/পুত্র হয়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ/আমার দুয়ার ধরি! ক্ষুধার্ত মানুষের অন্তরের কান্না কবিপ্রাণকে করেছিল বিচলিত। তাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা চাঁদ দেখে এখন কোনো কোনো কবিচিত্ত বলেন, আজকের চাঁদ পুড়ে হোক বাঁকা কাস্তে বা কাস্তের ফলার মতো চাঁদ। কবির মন তো উপমা-উৎপ্রেক্ষা জš§ভূমি। ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকারে বাস্তববাদী কবি কল্পনার স্বপ্নলোক ত্যাগ করে বাস্তবের রুঢ় জগতে দৃষ্টিপাত করেন। তার তখন মনে হয় ক্ষুধার্তের জীবনে পদ্য নেই, আছে শুধু খাদ্য।

মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে খাদ্য। অথচ বিশ্বব্যাপী দেখা দিচ্ছে খাদ্য অপচয় এক ভয়ংকর চিত্র। সম্প্র্রতি জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) এবং তাদের সহযোগী সংস্থা ডব্লিউআরএপির যৌথ উদ্যোগে তৈরি খাদ্য অপচয় সূচক প্রতিবেদন-২০২১ প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী ৯৩ দশমিক ১ কোটি টন খাদ্য অপচয় করা হয়েছে। এর মধ্যে গৃহস্থালি থেকে নষ্ট হয়েছে ৬১ শতাংশ খাবার। ২৬ শতাংশ খাবার নষ্ট করেছে খাদ্য বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। আর খুচরা বিক্রয়কেন্দ্রগুলো থেকে নষ্ট হয়েছে বাকি ১৩ শতাংশ খাবার। মানুষের জন্য উৎপাদিত খাবারের মধ্যে অপচয় হয় ১৩০ কোটি টন (মোট উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ)। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে বছরে পরিবারপ্রতি খাদ্য অপচয় হয় গড়ে ৬৫ কেজি। আর গৃহস্থালি থেকে দেশে প্রতি বছর মোট খাদ্য অপচয়ের পরিমাণ ১ কোটি ৬ লাখ টন। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই বছরে ১ কোটি ৬ লাখ ১৮ হাজার ২৩৩ টন খাদ্যের অপচয় হয়। রিপোর্টে বলা হয়, প্রতি বছর বিশ্বে মাথাপিছু ৭৪ কেজি করে খাবারের অপচয় হয়।

‘দ্য ফুড ওয়াস্ট ইনডেক্স রিপোর্ট ২০২১’ অনুসারে, ২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে যে পরিমাণ খাবার তৈরি হয়েছে, তার ১৭ শতাংশই অপচয় করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের প্রধান বলেছিলেন, সম্পদের স্বল্পতা নয়; খাদ্যের অপচয়ই বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার প্রধান কারণ।

একদিকে খাদ্যের অপচয় হচ্ছে আর অন্যদিকে বিশ্বে ক্ষুধায় ভোগা মানুষের সংখ্যা ৩০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে; প্রায় ৮০ কোটি মানুষ প্রচণ্ড অপুষ্টিতে ভুগছে। এখনও পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় কাতর। সিরিয়া, লিবিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশে মানুষ ঘাসের স্যুপ, ঘাসের রস, ডাস্টবিনের ফেলে দেয়া খাবার খেয়ে দুর্ভিক্ষের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে। মা তার কোলের শিশুকে বিক্রি করে দিচ্ছে। মৃত্যুর আগে সিরীয় এক ছোট্ট শিশু আর্তনাদ করে বলছেÑ‘আমি আল্লাহকে সব বলে দেব।’

বিশ্বে প্রতি বছর যে পরিমাণ খাবারের অপচয় হয়, তা উৎপাদনে ১৪০ কোটি হেক্টর জমি ব্যবহƒত হয়; যা বিশ্বের মোট কৃষিজমির ২৮ শতাংশ। এ বাড়তি খাবার উৎপাদনে প্রতিনিয়ত বনভূমিকে কৃষিজমিতে পরিণত করা হচ্ছে। এর ফলে পরিবেশ ও জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষা কঠিন হয়ে পড়ছে। ফলমূল, শাকসবজি, মাছ-মাংস উৎপাদনে কীটনাশক, রাসায়নিক সার ব্যবহারে নদী-নালা, খাল-বিল, ফসলের ক্ষেত বিষময় হয়ে উঠছে। এতে মানুষসহ জীবজন্তু, পশুপাখি বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। খাদ্য উৎপাদনে জ্বালানির ব্যবহার গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। কার্বন নিঃসরণসহ পরিবেশ দূষণে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখে অপচয়কৃত খাবার আর এতে প্রতি বছর ৩৩০ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সসাইড বাতাসে ছড়াচ্ছে।

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। অথচ কত স্বার্থপরতার মাঝেই না আমরা বসবাস করছি। বর্তমান সময়ে? মানুষের মাঝে মনুষ্যত্ববোধের এত বেশি পরিমাণ অভাব দেখা দিয়ে?ছে যে মানুষ শুধু নিজ চিন্তায় মগ্ন থাকে। কিন্তু সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের হওয়া উচিত ছিল মানবিক, সেইসঙ্গে ভাবা উচিত ছিল গোটা সৃষ্টিকে নিয়ে?। বর্তমান সমাজের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, মানুষের মাঝে শুধু নিজের জন্য চিন্তা পাড়া-প্রতিবেশী, আশপাশের দরিদ্র, অনাহারে থাকা মানুষদের প্রতি সামান্য চিন্তা ও দয়া মানুষের মাঝে নেই। যার ফলস্বরূপ খাদ্য অপচয় বর্তমান সময়ে? অভিশাপে রূপ নিয়েছে। যার প্রভাব আমাদের বাংলাদেশেও প্রবলভাবে বিদ্যমান। আমাদের সমাজের মানুষের মাঝে কিছু কিছু অভ্যাস খাবার অপচয়ের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করে। বর্তমান সময়ে? আমাদের সমাজে সবচেয়ে? লক্ষণীয় হলো, অনুষ্ঠানে নিজেদের আর্থিক সামর্থ্য প্রদর্শনের জন্য খাবারের নানারকম পদের সংখ্যা ও পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। নানারকম উৎসবের দিনগুলোয় খাবার অপচয় পরিমাণ যেন আরও কয়ে?কগুণ বেড়ে যায়। বিয়ে?, জš§দিন, পারিবারিক উৎসব, অনুষ্ঠান আয়ে?াজনের সময় অপরিকল্পিত খাবার ব্যবস্থাপনায় প্রচুর খাবার অপচয় হয়। রান্না করা হয় প্রয়োজনের চেয়ে অধিক খাদ্য এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওয়ে?টারদের খাবার প্লেটে অতিরিক্ত খাবার তুলে দেয়ার ফলে প্লেটে বাকি থেকে যাওয়া খাবার ফেলে দেয়া হয় ডাস্টবিনে। এছাড়া আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষের মাঝে অতিথিদের জোর করে বেশি বেশি খাবার তুলে দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এতে খাবারের অপচয় হয়।

বিশ্বজুড়ে বছরে মোট খাবারের ১৭ শতাংশ রেস্তোরাঁ ও দোকানে অপচয় হয়। সম্প্রতি বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্টে দেয়া হচ্ছে নানা ধরনের লোভনীয় বুফে অফার। হোটেল-রেস্তোরাঁ-বুফেতে চলে খাদ্য অপচয়ের মহাউৎসব। এসব রেস্টুরেন্টে মানুষ নিজেদের পেট ভরে যাওয়ার পরও শুধু নিজের চোখের ক্ষুধার মেটানোর জন্য পরিমাণের অনেক বেশি খাবার নিজের প্লেটে তুলে নেয় এবং খেতে না পারার ফলে সেসব খাবার ফেলে দেয়া হয়। সম্প্রতি একটি বুফেতে তাদের অপচয়কৃত খাদ্য পরিমাপ করে দেখে, তার পরিমাণ ২৯ কেজি, অনেক সময় তারও বেশি, যা দিয়ে খুব সহজেই ৮৫ থেকে ৯০ জন অভুক্ত মানুষকে খাওয়ানো যেত। এসব বুফেতে খাদ্য অপচয় রোধ করতে অপচয়কৃত খাদ্যের ওপর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা চার্জ করা প্রয়ে?াজন।

কোনো মতো, প্রথা অথবা ধর্ম অপচয়কে সমর্থন করে না; বরং সব ধর্মেই মিতব্যয়িতাকে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। আমাদের ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কোরআনের ১৭নং সুরা-আল ইসরা’র ২৭নং আয়াতে বলা হয়েছে‘অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই, আর শয়তান তো তার প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ।’ মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘খাও, পান করো। কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয় আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আ’রাফ: ৩১)

খাদ্য অপচয় ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। একজন মানুষ কতটুকু খাবে, কীভাবে খাবে তার সঠিক দিকনির্দেশনা ও খাবার গ্রহণের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ইসলাম দিয়েছে। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, তোমাদের পেটের এক-তৃতীয়াংশ খাবার দিয়ে, এক-তৃতীয়াংশ পানি দিয়ে পূরণ কর এবং বাকি অংশ খালি রাখো; অথবা এমন পরিমাণে আহার কর, যেন খাওয়া শেষে তৎক্ষণাৎ সমপরিমাণ খাবার খেতে পার। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানও ইসলামের এ ব্যাখ্যাকে সমর্থন করে। হজরত আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.) যখন আহার করতেন, আহার শেষে তিনবার আঙুল চেটে খেতেন এবং বলতেন, তোমাদের খানার বাসন থেকে কিছু পড়ে গেলে উঠিয়ে পরিষ্কার করে খেয়ে নাও, তা শয়তানের জন্য ছেড়ে দিও না। (আবু দাউদ : ৩৮৪৫)। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ওই ব্যক্তি মুমিন নয়, যে পেট পুরে খায় অথচ তার পাশের প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে। (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস: ১১২)। অথচ ইসলামে বলা হয়েছে তোমার প্রতিবেশী কেউ যদি অভুক্ত থাকে, তাহলে তার দায়দায়িত্ব তোমার ওপরও বর্তায়। আমরা অবলীলাভাবে এসব দিকনির্দেশনার কথা যেন ভুলেই গেছি, সেইসঙ্গে ভুলতে বসেছি মনুষ্যত্ব বোধ ও মানবিকতাবোধ।

খাদ্য অপচয় রোধ করতে হলে সবার মাঝে খাদ্য অপচয় সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে এবং একই সঙ্গে তৈরি করতে হবে খাদ্য শৃঙ্খল বিধান এবং তা মানার জন্য যথেষ্ট প্রচেষ্টা। সরকারি ও বেসরকারি নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদনের পর থেকে খাবার পরিবেশন পর্যন্ত নীতিমালা ও সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং তা নিয়মিত মনিটরিং ব্যবস্থা করতে হবে। খাদ্য অপচয় রোধে খাদ্য উৎপাদন, জমিতে ফসল ফলানোর পর সেই ফসল কাটা, সংরক্ষণ, পরিবহন, প্রক্রিয়াকরণে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া প্রতিটি ব্যক্তিকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে। নিজ নিজ বাড়িতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত রান্না নয় এবং কেনাকাটায় সুনির্দিষ্ট তালিকা করা, শাকসবজি সঠিক নিয়মে সংরক্ষণ করা, জিনিসপত্র কেনার পূর্বে মেয়াদ দেখে কেনা প্রভৃতি বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। সেই সঙ্গে সমাজে আমরা যেহেতু দলবদ্ধভাবে বসবাস করি, সেহেতু আমাদের আশপাশে বসবাসকৃত মানুষদের মাঝে খাদ্য অভাব আছে কি না, সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। ভবিষ্যতের পৃথিবী হবে একটি ক্ষুধামুক্ত পৃথিবীর এই আশাই ব্যক্ত করছি।

শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০