খাদ্য উৎপাদন ও ভোগের হিসাবে গরমিল আছে

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে যে পরিমাণ চাল উৎপাদন হয় আর যে পরিমাণ চাল ভোগ হয়, এ দুইয়ের হিসাবের মধ্যে ত্রুটি আছে। বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদনের হিসাব প্রকৃত উৎপাদনের চেয়ে বাড়িয়ে দেখানো এবং ভোগের হিসাব প্রকৃত ভোগের তুলনায় কম দেখানো হচ্ছে। এছাড়া স্বাধীনতার পর থেকে অনেক অগ্রগতি হলেও বর্তমানে নতুন ও পুরোনো মিলে দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ১০ ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিনিয়োগে স্থবিরতাসহ এগুলো সমাধানে গুরুত্ব না দিলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে না। সেই সঙ্গে শুধু আয়ভিত্তিক দারিদ্র্য হার নিরূপণ না করে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য হার হিসাব করার সময় এসেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এসব বিষয় তুলে ধরা হয়। সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিআইডিএস সম্মেলন কক্ষে এ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। সংস্থাটির মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেনের সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান।

‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা: সুবর্ণজয়ন্তীতে ফিরে দেখা’ শীর্ষক বইটি লিখেছেন রুশিদান ইসলাম, রিজওয়ানুল ইসলাম এবং কাজী সাহাবউদ্দিন। বইয়ের ওপর আলোচনায় অংশ নেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ও বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো কাজী ইকবাল। এছাড়া বক্তব্য দেন পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিলুর রহমান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মজিদ, পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর প্রমুখ।

বইটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়েছে প্রধানত তিনটি বিষয়ের ওপর। এগুলো হলোÑকৃষিতে উচ্চফলনশীল ধান, শ্রমনিবিড় রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প এবং বিদেশে কর্মসংস্থান ও রেমিট্যান্স। এ তিনটিতেই মুখ্য ভূমিকা রেখেছে শ্রম এবং শ্রমজীবী মানুষ। যদিও এর সঙ্গে প্রযুক্তি এবং উদ্যোক্তাদের অবদানও রয়েছে। বর্তমান অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো হলো দেশজ সঞ্চয় ও বিনিয়োগে স্থবিরতা রয়েছে। বর্তমানে বিনিয়োগের হার ৩১-৩২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০৩১ সালে ৪১ শতাংশ এবং ২০৪১ সালে তা ৪৭ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। বিনিয়োগের স্থবিরতা কাটানোর বিকল্প নেই। বিনিয়োগের অদক্ষতাও অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এছাড়া একটি শিল্প ও প্রবাসী আয়ের ওপর অতি নির্ভরশীলতা। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮-৯ শতাংশে উন্নীত করা। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্য নির্মূল করা, বৈষম্য কমানো এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার কমতে না দেওয়া।

সেই সঙ্গে নতুন চ্যালেঞ্জগুলো হলোÑকরোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে সৃষ্ট নতুন অর্থনৈতিক সংকট থেকে অর্থনীতিকে বাঁচানো। পুনরুজ্জীবনের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত হতে না দেয়া। নতুন দরিদ্রদের আবার দারিদ্র্য থেকে উদ্ধার করা। কর্মসংস্থান বাড়ানো। সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম বৃদ্ধি এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন করার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অনুষ্ঠানে জানানো হয় বইটিতে আছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: সাফল্য, ঝুঁকি ও সম্ভাবনা। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি। শিল্পায়ন ও সেবা খাতের প্রসার: অর্জন ও চ্যালেঞ্জ। কৃষির অগ্রগতি, চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা। খাদ্য নিরাপত্তা: অর্জন, প্রতিবন্ধকতা এবং সম্ভাবনা। কর্মসংস্থান, শ্রমবাজার ও বেকারত্ব। দারিদ্র্য পরিমাপ, বিশেষণ ও দারিদ্র্য রেখা এবং নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের বিষয়গুলো বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।

দেশে খাদ্য উৎপাদনের যে তথ্য দেখানো হয়, তা কতটা সঠিকÑএ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে লেখক কাজী সাহাবউদ্দিন বলেন, খাদ্য উৎপাদনের হিসাব প্রকৃত উৎপাদনের চেয়ে বাড়িয়ে দেখানো এবং ভোগের হিসাব প্রকৃত ভোগের তুলনায় কম দেখানো হচ্ছে মনে হয়। এ হিসাব চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করা প্রয়োজন।

ড. বিনায়ক সেন জানান, দেশে নতুন করে ৪৫ লাখ মানুষ নতুন দারিদ্র্য হয়েছে। ঢাকা শহরের ১ হাজার ৮৯১ জন মানুষকে নমুনা বা স্যাম্পল হিসেবে ধরে একটি জরিপ পরিচালনা করেছে বিআইডিএস। এর প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, করোনা মহামারির আগে রাজধানীতে দারিদ্র্য হার ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। বর্তমানে সেই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশে। এর মধ্যে সাড়ে ৬ শতাংশের ওপরে দারিদ্র্য হার বেড়েছে। কিন্তু আশার কথা হলোÑকরোনাকালে যখন প্রথম লকডাউন দেয়া হয়, তখন রাজধানীতে নগর দারিদ্র্য বেড়ে দাঁড়ায় ৪২ শতাংশে। করোনার ডেল্টা ভেরিয়েন্ট যখন এলো তখন সেটি কিছুটা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৩৬ শতাংশে। এছাড়া ওমিক্রনের সময় এ হার আরও কমে গিয়ে হয়েছিল ২১ শতাংশ। বর্তমানে সেটি কমে হয়েছে ১৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। নাগর দারিদ্র্য হার বেয়ারা রকমের বাড়েনি, যা বেড়েছিল তা কমতির দিকে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে এমএ মান্নান বলেন, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি টেকসই করতে হলে সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এই অগ্রগতি ধরে রাখতে কাজ করার বিকল্প নেই।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ড. মসিউর রহমান বলেন, বিনিয়োগ যতটা হতাশাজনক বলা হয় পরিস্থিতি ততটা হতাশাজনক নয়। চীনের তুলনায় একটু কম হলেও অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের তুলনায় স্বস্তিদায়ক অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বেড়েছে মূলত ক্যাপিটাল ইনপুট বৃদ্ধির কারণে। তবে কৃষি খাতে মৌসুমি শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে। এজন্য কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের প্রসার ঘটানো হচ্ছে। আবার কর্মসংস্থানের রূপান্তরের ক্ষেত্রেও দক্ষতার ঘাটতি আছে। বিশেষ করে গ্রাম থেকে শহরে যারা কর্মসংস্থানে যাচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার বেশ ঘাটতি রয়েছে। এক্ষেত্রে দেশে চলমান দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর গতিহীনতা রয়েছে। দেশে বহুমাত্রিক বৈষম্য বাড়ছে। কেননা সুপেয় পানির ঘাটতি, পর্যাপ্ত স্যানিটেশন কিংবা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় পিছিয়ে পড়ছে বিশেষ কিছু জনগোষ্ঠী। ফলে এই শ্রেণির উন্নয়নে কার্যক্রম শক্তিশালী করা হচ্ছে। এজন্য অর্থনীতিতে বহু স্তরবিশিষ্ট হতে হবে।

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, করোনার কারণে দেশে যে নতুন দারিদ্র্য বেড়েছে সেটি ঠিক; যা বিআইডিএসের জরিপেও উঠে এসেছে। এটা আমরাও বলে আসছি। এখন এমন একটা পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যেখানে নিয়মের কোনো প্রয়োজন নেই। যেভাবেই হোক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। এরই ফল হিসেবে উদাহরণ হচ্ছে আজকে সীতাকুণ্ডে যে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। এদেশের উন্নয়ন হচ্ছে চুইয়ে পড়ার অর্থনীতি। অর্থাৎ ওপর থেকে চুইয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যেটুকু পড়বে সেটুকু পাবে গরিবরা। এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, শুধু আয়ভিত্তিক দারিদ্র্য নিরসন করলেই হবে না। বহুমাত্রিক দারিদ্র্য নিরূপণে কাজ করতে হবে। বিনিয়োগ বাড়ানোটা হচ্ছে আগামীর অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান বৈষম্য বাড়ছে। বিশেষ করে আয়ভিত্তিক বৈষম্য বেড়েই চলছে।

ড. আব্দুল মজিদ বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়নের বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে। ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, খাদ্য-সংক্রান্ত যেসব তথ্য দেয়া হচ্ছে, সেগুলো সঠিক নয়। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উৎপাদন ও ভোগের মধ্যে সমস্যা কোথায় সেটি খুঁজে বের করতে হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০