মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান: খাদ্য নিরাপত্তা বলতে আমরা বুঝি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ধনী-গরিব নির্বিশেষে দেশের সব মানুষের খাদ্যের নিশ্চয়তা। আর খাদ্যে জেন্ডার সমতায়ন বলতে বুঝি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে খাদ্যে সব মানুষের সমঅধিকার। বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে এখনও জেন্ডারভিত্তিক খাদ্যের সমতায়নে বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহে টেকসইভাবেই অনেকটা এগিয়ে গেছে। তবে এখনও জনগোষ্ঠীর একটি অংশ খাদ্যের নিরাপত্তাহীনতা তথা ক্ষুধার্ত থাকছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) তথ্যমতে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশের এক-চতুর্থাংশ তথা চার কোটি লোক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে ছিল। ২০১৫ সালে জিএইচআই যে রিপোর্ট প্রকাশ করে, তাতে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৭.৩, যাকে ক্ষুধা নিরূপক সূচক হিসেবে ‘সিরিয়াস ক্যাটেগরি’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এফএও ২০১৪ সালে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গবেষণা অনুযায়ী ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ও চরম অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের ৬০ ভাগই নারী ও শিশু। গত ২১ অক্টোবর ২০১৮ রাজধানীতে অনুষ্ঠিত ‘কিশোর-কিশোরী সমাবেশ’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত উল্লেখ করেন, দেশে এখন তিন কোটি মানুষ দরিদ্র। যাহোক, গবেষণায় দেখানো হয়েছেÑখাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে জেন্ডারের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। খাদ্যের চাহিদা, জোগান ও বণ্টনÑএ তিন পর্যায়েই একে অপরের সম্পর্ক গভীর।
সমাজ ও পরিবারে নারী-পুরুষের অবস্থান ও ভূমিকাই খাদ্য নিরাপত্তায় জেন্ডার অসমতা তৈরি করে। সন্তান-সন্ততি ধারণ, পরিবারের অন্যান্য সদস্য বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক সদস্য ও মেহমানদের খাবার-দাবার এবং দেখাশোনার দায়িত্ব নারীকেই পালন করতে হয়। কিন্তু খাদ্য নিরাপত্তার যে তিনটি শর্ত খাদ্যের উপলভ্যতা, খাদ্যের অধিকার ও সুযোগ এবং খাদ্যের যথাযথ ব্যবহারে নারীদের অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ সব সময় থাকে না। শেষে দেখা যায়, সবাইকে সুষ্ঠু ও পরিপূর্ণভাবে খাওয়াতে গিয়ে নিজের ভাগেই টান পড়ে। আবার শিক্ষা, চাকরি, অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থার ওপরও নারীদের খাদ্য নিরাপত্তার ওপর অধিকার নির্ভর করতে দেখা যায়। এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থায় যেখানে নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা রয়েছে, সে পরিবারে খাদ্য নিরাপত্তা অধিক সুসংহত। আবার পরিবারের উৎপাদনশীলতায় নারীর অধিকার ও ভূমিকা খাদ্যের উৎপাদন ২০ থেকে ৪০ শতাংশ উৎপাদন বাড়িয়ে দিতে পারে বলে গবেষণায় দেখা গেছে, তাও সম্পূর্ণ রয়েছে। সার্বিক বিচারে জেন্ডার সমতায়ন ও খাদ্য নিরাপত্তার মধ্যে সম্পর্ক গভীর।
খাদ্য পাওয়ার অধিকার ও সুযোগের বেলায় দেখা যায়, খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে কিছু কিছু পরিবার, বিশেষত দরিদ্র ও নি¤œবিত্ত পরিবারের পরিমাণমতো খাদ্যপ্রাপ্তি দুষ্প্রাপ্য হয়ে দাঁড়ায়। আর সে পরিবারে যদি নারী প্রধান হয়ে থাকে, তবে সেখানে নারী নিজেই কম খেয়ে সে দুষ্প্রাপ্যতা সামাল দেয়।
খাদ্য নিরাপত্তায় জেন্ডার সমতায়নে সরকার অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে। এক হিসাবে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার ওপর যেসব প্রকল্প বা প্রোগ্রাম রয়েছে, এর মধ্যে ২২৫টি প্রকল্প প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খাদ্যের উপলভ্যতার ওপর, ১০৭টি খাদ্যের এক্সেস তথা খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিতকরণের ওপর এবং ৪৮টি প্রকল্প রয়েছে খাদ্যের ইউটিলাইজেশন তথা খাদ্যের সঠিক ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে তৈরি হয়েছে। খাদ্যের জোগান বাড়ানোর জন্য সোশ্যাল সেফটি নেট প্রোগ্রাম, পাবলিক ফুড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম, প্রোগ্রাম ফর ফুড অ্যান্ড ভালনারেবল উইমেন, সেফটি নেট ফর চিলড্রেন প্রভৃতি নামে খাত/উপখাতের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়াস চালাচ্ছে সরকার। বলা যায় বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে বিশেষ সফলতাও লাভ করেছে। আশ্বিন-কার্তিক মাসের মঙ্গা এখন বাংলাদেশে নেই। বড় বড় দুর্যোগেও এখন কেউ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে তেমনটি শোনা যায় না। বয়োবৃদ্ধদের জন্যও অনেক প্রোগ্রাম রয়েছে দেশে খাদ্যের জোগান দেওয়ার জন্য, বিশেষত মজুরির টাকা বেড়ে যাওয়ায় শ্রমিক-মজুরের খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধি পেয়েছে। নারীদের ঘর থেকে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে আসার প্রবণতা তাদের খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখছে।
খাদ্য নিরাপত্তায় জেন্ডার সমতায়নে সর্বপ্রথমে প্রয়োজন পারিবারিক সচেতনতা। সন্তান গর্ভধারণের পর নারীকে কম খেতে হবে এ অসত্য ও কুসংস্কার থেকে বাংলাদেশ এখন অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে। পরিবারের শাশুড়িরাও এখন মিডিয়ার কল্যাণে অনেক সচেতন হয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে পরিবারের পুরুষদের ভূমিকা অনেক। প্রথমেই তাকে ভাবতে হবে তার আয়-রোজগার পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য। পরিবারের সব সদস্য সার্বিকভাবে সুষম খাবার পেল কি না অথবা আপদকালের জন্য কিছু খাদ্য জমা আছে কি না, তা তাকে ভাবতে হবে। পরিবারের একেকজনের খাদ্যাভ্যাস তথা খাদ্য পছন্দ একেকরকম হতে পারে। অধিক মূল্য দিয়ে পরিবারের খাদ্যতালিকা তথা খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করতে হবে। নারীকে নারী না ভেবে নিজের মা-বোন, স্ত্রী বা মেয়ে হিসেবে ভাবতে হবে। খাদ্য গ্রহণে পরিবারকে বেশি মাত্রায় বিকল্প খাবারের জোগান দিতে হবে। বিশেষ খাদ্যের প্রতি কারও কারও বিশেষ দুর্বলতা থাকতে পারে। সেটাকে সম্মান করতে হবে। নিজের আয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে অধিকতর সুষম খাদ্যতালিকা করতে পারাটাও গুরুত্বপূর্ণ।
খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে জেন্ডার সমতায়নের বিষয়ে আরও অনেক বেশি সচেতনতা প্রয়োজন। গণমাধ্যমসহ স্কুল-কলেজের শিক্ষক, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে আমরা কিছু কিছু খাদ্য এখন রফতানিও করছি। আবার উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের খাদ্যতালিকায় নিত্যনতুন খাদ্য অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সেখানে খাদ্য নিরাপত্তায় এখনও জেন্ডার সমতায়নের বিষয়টি আলোচনায় আসা অবশ্যই দেশের জন্য প্রয়োজন। আশা করা যায়, সব পলিসি লেভেলে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে এবং পুরুষসহ পরিবারের সব সদস্যের মন-মানসিকতায় পরিবর্তন ঘটিয়ে শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান করে একটি সক্ষম জাতি হিসেবে আমাদের প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, যেখানে খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে জেন্ডার সমতায়নের বিষয়টি বিশেষভাবে মনোযোগ পাবে।
পিআইডি নিবন্ধ