নিজস্ব প্রতিবেদক: জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের সাজা কেন বাড়ানো হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। গতকাল বুধবার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক রিভিশন আবেদনের শুনানি করে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রুল জারি করেন, যা রাষ্ট্র ও খালেদা জিয়াকে চার সপ্তাহের মধ্যে এই রুলের জবাব দিতে হবে। আর রুলের ওপর শুনানি হবে খালেদা জিয়ার আপিলের সঙ্গে।
আদালতে দুদকের রিভিশন আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক। আর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষে ছিলেন এজে মোহাম্মদ আলী, মওদুদ আহমদ ও জয়নুল আবেদীন।
আদালত আদেশে বলেছেন, দুদক আইনে সাজার রায়ের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ হয়ে এ ধরনের রিভিশন বা আপিল দুর্নীতি দমন কমিশন করতে পারে কিনাÑসে বিষয়টি আলোচনা ও ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আখতারুজ্জামান গত ৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলার রায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর এবং খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ অপর পাঁচ আসামির প্রত্যেককে ১০ বছর ও অর্থদণ্ড দেন।
ওই রায়ের পর থেকেই খালেদা জিয়া পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। হাইকোর্ট তাকে জামিন দিলেও আপিল বিভাগে ওই আদেশ আটকে আছে।
সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়ার পাঁচ বছর সাজার রায় এসেছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থেকে অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে ‘অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের’ কারণে, ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায়।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে নি¤œ আদালত বলেছেন, সরকারি এতিম তহবিলের টাকা এতিমদের কল্যাণে ব্যয় না করে পরস্পর যোগসাজশে আত্মসাৎ করে খালেদা জিয়াসহ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার আসামিরা রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধ করেছেন।
বাকি পাঁচ আসামিকে এই ধারার সর্বোচ্চ সাজা দিলেও প্রধান আসামিকে কম দণ্ড দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে রায়ের দিন বিচারক বলেন, অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলেও বয়স ও সামাজিক মর্যাদার কথা বিবেচনা করে খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
ওই রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর গত ২০ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে আপিল করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। ২২ ফেব্রুয়ারি তা শুনানির জন্য গ্রহণ করে খালেদার অর্থদণ্ড স্থগিত করেন আদালত।
হাইকোর্ট সে সময় চার মাসের মধ্যে পেপার বুক প্রস্তুত করার নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, পেপার বুক প্রস্তুত হয়ে গেলে যে কোনো পক্ষ শুনানির জন্য আপিল উপস্থাপন করতে পারবে।
কিন্তু মামলাকারী ও তদন্তকারী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন খালেদা জিয়ার সাজার মেয়াদ বাড়াতে বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে একটি রিভিশন আবেদন করে গত ২৫ মার্চ। সেই আবেদনই বুধবার গ্রহণযোগ্যতার ?শুনানির জন্য বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের বেঞ্চে আসে।
শুনানিতে দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলন, ‘আদালত মুখ্য আসামিকে পাঁচ বছরের সাজা দিয়েছেন, আর সহযোগী আসামিদের দিয়েছেন ১০ বছরের সাজা। এটা সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য। তাছাড়া এ আবেদনে পুরো রায়টিকে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি, চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে রায়ের অংশবিশেষ। ফলে আমাদের আবেদনটি গ্রহণ করে সাজা বাড়ানোর প্রশ্নে রুল জারির আরজি জানাচ্ছি।’
দুদকের আইনজীবীর বক্তব্যের বিরোধিতায় খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘এ মামলায় আসামিদের বিশেষ আইনে সাজা হয়েছে। এ আইনের অধীনে রিভিশন বা আপিল করতে হলে আইনটি সংসদে সংশোধন করে আসতে হবে।’
বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, যেহেতু আইনের প্রশ্ন উঠেছে, তাই এর সমাধান হওয়া দরকার।
খালেদার অপর আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলী তখন বলেন, ‘বিশেষ আইনে আপিলের বিধান আছে। সেখানে বলা আছে আসামি খালাসপ্রাপ্ত হলে আপিল করা যাবে। কিন্তু ১০(এ)তে রিভিশন আবেদনের যে বিধান আছে সেটি খুবই সীমিত অর্থে। তাহলে দুদক কীভাবে সংক্ষুব্ধ হয়? এখানে দুদকের সংক্ষুব্ধ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে দুদক কেন এই বিতর্কিত ভূমিকা নিল? কারণ এটি একটি অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খেলা। ফলে দুদকের আবেদন গ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই।’
বিচারক তখন বিএনপি নেত্রীর আইনজীবীদের বলেন, ‘তারা যদি ভুল করে, তাহলে এর সুবিধা কি আপনারা পাবেন না? দুই পক্ষ আপিল এবং রিভিশন আবেদনের বিধান নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছে, তা আলোচনা ও ব্যাখ্যার দাবি রাখে।’ এরপর আদালত খালেদা জিয়ার সাজা বাড়ানোর প্রশ্নে রুল জারি করেন।
আদেশের পর খালেদা জিয়ার আইনজীবী মওদুদ আহমদ অভিযোগ করেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছে না। রাজনৈতিক চাপে তারা খালেদা জিয়ার সাজার বিরুদ্ধে রিভিশন আবেদন করেছে।
অন্যদিকে খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘মাননীয় বিচারপতি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, খালেদা জিয়া যে মুখ্য আসামি এটা কোথায় আছে? সেটা আমি রায় থেকে পড়ে আদালতের দৃষ্টিতে এনেছি। দুই পক্ষকে শুনেই আদালত আদেশ দিয়েছেন, বিষয়টা এক্সামিন করা উচিত।’
এ মামলার দুই আসামি খালেদা জিয়া এবং কাজী সলিমুল হক কামাল হাইকোর্টে যে আপিল করেছেন, তার সঙ্গেই এ রুলের শুনানি হবে বলে জানান দুদকের আইনজীবী।
দুদক সরকারের প্রভাবে কাজ করছে বিএনপির এমন অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে খুরশীদ আলম বলেন, আপিল করা হবে কিনা, দুর্নীতি দমন কমিশন সে সিদ্ধান্ত নিজেই নেয়। সরকার দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ‘প্রশ্নই আসে না’।
দুদক আইনে রিভিশন আবেদনের সুযোগ আছে কিনা এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা শুনানিতে বলেছি, ১০(এ)তে রিভিশনের প্রভিশন আছে। অর্থাৎ যেখানে আপিল করা যায়, সেখানে রিভিশনও করা যায়। অপরাধ যখন প্রমাণ হয়েছে, সেখানে শারীরিক অসামর্থ্য, বয়স, রাজনৈতিক দলের প্রধান এগুলো বলে তাকে মার্সি দেওয়ার সুযোগ নেই।’
ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী দুদক আপিল করল না কেন এ প্রশ্নে খুরশীদ বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪১৭ (এ) ধারা সরকারের জন্য। আমি সরকার না, আমি দুদক। তাও আপিল করা যায় আসামি খালাসপ্রাপ্ত হলে। এখানে তো আসামি খালাস হয়নি, সাজা দিয়েছে পাঁচ বছর। কয়েকটা বাক্য-শব্দের কারণে আমরা রিভিশন করতে বাধ্য হয়েছি।’

Print Date & Time : 25 June 2025 Wednesday 12:02 pm
খালেদা জিয়ার সাজা কেন বাড়বে না
পত্রিকা ♦ প্রকাশ: