হামিদুর রহমান, ঝালকাঠি থেকে ফিরে: ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে তিন জেলার সীমান্তবর্তী ভীমরুলি খালের ভাসমান হাট। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে খাল ঘেঁষেই গড়ে উঠছে বিভিন্ন খাবার হোটেল, মার্কেটসহ বিভিন্ন টংদোকান। আর নজরদারি না থাকায় এসব খাবার দোকান ও মার্কেটের প্লাস্টিক-পলিথিন খালেই ফেলা হচ্ছে। এছাড়া খাল দখল করে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা গড়ে তুলছেন স্থানীয়রা।
সরেজমিনে দেখা যায়, স্বরূপকাঠির ভাসমান হাট দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে যাচ্ছেন পর্যটক। আর খাবার খেয়ে ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের প্লেট ও চায়ের প্লাস্টিক কাপ পানিতে ফেলছেন তারা। শুধু পর্যটকরাই নন, একই ধরনের কাজ করছেন খালের পাশে দোকান গড়ে তোলা বিভিন্ন দোকানিও। নিজেদের দোকান পরিষ্কার রাখতে সব ধরনের বর্জ্য তারা ফেলছেন খালের পানিতে।
স্থানীয়রা বলছেন, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এ হাট দেখতে এখন বিপুলসংখ্যক পর্যটক আসছেন। তবে সচেতনতা ও প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় বাজারের খাল ঘেঁষে গড়ে উঠছে বিভিন্ন খাবার হোটেল ও মার্কেট, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠেছে।
উল্লেখ্য, ভাসমান হাটে বিভিন্ন রকমের দেশি ফল বিক্রি হলেও মূলত পেয়ারা বিক্রি হয় বেশি। এজন্য হাটটি ‘ভাসমান পেয়ারার হাট’ নামেই বেশি পরিচিত। বরিশালের তিন জেলা ঝালকাঠি, বরিশাল, পিরোজপুরের সীমান্তবর্তী ভীমরুলি খাল।
শত বছরের পুরোনো এ হাটের আশেপাশে আছে ২০০ বছরের পুরোনো পেয়ারা বাগান। যেসব বাগান থেকে উৎপাদন হয় লক্ষাধিক মণ পেয়ারা। একসময় দাম না পেয়ে এই হাটে চাষি পেয়ারার নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে খালি নৌকা নিয়ে ফিরে যেত বলে জনশ্রুতি আছে। তবে সম্প্রতি পর্যটন সম্ভাবনা বাড়ায় এ বাজারের জৌলুস বাড়তে শুরু করেছে।
নদী ও পরিবেশ নিয়ে প্রায় ১০ বছর ধরে কাজ করছেন ফারুক আহমেদ। বাংলাদেশের পর্যটন এলাকা নিয়মিত ঘোরাঘুরি ও পরিদর্শন করেন তিনি। সম্প্রতি ঝালকাঠির ভাসমান বাজারে ঘুরতে এসেও তার দেখা মেলে। সেখানকার অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা হলে অত্যন্ত ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এ চর্চাটা খুব খারাপ। আমাদের দেশে কোনো পর্যটন কেন্দ্র জনপ্রিয় হয়ে উঠলে সেখানে নানা রকম সিন্ডিকেট তৈরি হয়। ভাসমান পেয়ারা বাজার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। এটি হুট করে গড়ে ওঠেনি। তবে জনপ্রিয় হওয়ায় এখন এর পরিবেশ নষ্ট হওয়া শুরু হয়েছে। ছুটির দিনে এখানে প্রচুর দর্শনার্থী প্রবেশ করেন। দেখা যায়, দর্শনার্থীদের ট্রলারের জন্য বাজারে বেচাকেনা করতে আসা পেয়ারা চাষিদের সমস্যা হচ্ছে। অনেক সময় পেয়ারাসহ নৌকা ডুবে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এসব দর্শনার্থী যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলছে খাল ও এর আশেপাশে। বিশেষ করে পলিথিন ও খাবারের প্লাস্টিকের বক্সগুলো খালেই ফেলা হচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তার ওপর সরু খাল, ভাসমাস বাজারের সঙ্গে কোনো দূরত্ব ছাড়াই খাল দখল করে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন খাবার হোটেল ও মার্কেট।
এদিকে ট্রাভেলারস অব বাংলাদেশ নামে এক ট্রাভেল লিংক গ্রুপে ভাসমান বাজারের অভিজ্ঞতা নিয়ে শাহিনুর আড়াইহাজারী এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন: নজরদারি ও সচেতনতার অভাবে বিভিন্ন অনিয়ম শুরু হয়েছে ভাসমান পেয়ারার হাটে। নানা প্রান্ত থেকে দলে দলে ঘুরতে আসা ট্যুরিস্টরা বিরিয়ানি খেয়ে খালেই প্যাকেট ফেলে যাচ্ছেন। যেটি পরিবেশের জন্য হুমকি। এছাড়া শুরু হয়েছে ইকোপার্ক, পেয়ারা বাগানে কিছু বসার জায়গা, টয়লেট আর খাওয়ার জায়গা গড়ে তোলার কাজ। আপাতত টিকিট ৩০ টাকা। দেখার কিছুই নেই। এত সুন্দর একটি এলাকা। এখানে সরকারের নজরদারি না থাকায় বিভিন্ন সিন্ডিকেটের দখলে চলে যাচ্ছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, এলাকায় কিছু অসাধু মানুষ টাকার লোভে কৌশলে খালের পাশে মাটি ফেলে ভরাট করে মার্কেট ও হোটেল নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। ভাসমান বাজারের খালের পাশ ঘেঁষেই একটি মন্দির রয়েছে। এ মন্দিরকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে জায়গা বাড়ানোর নামে এখানেই মার্কেট করার পরিকল্পনা করছে কিছু অসাধু মহল।
জানতে চাইলে ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিষয়গুলো আমাদের নজরে আছে; আমরা প্রতিনিয়তই মনিটরিং করছি। পর্যটক থেকে শুরু করে স্থানীয় দোকানিদেরও সচেতন করা হচ্ছে নির্দিষ্ট স্থানে প্লাস্টিক-বর্জ্য ফেলতে। প্রতিদিনই আমাদের নজরদারি বাড়ছে। পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে সরকারের একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, প্রকল্পের আওতায় পর্যটকদের জন্য ওয়াশ ব্লক তৈরি করা হচ্ছে। যেখানে তারা গোসল করতে পারবেন। এছাড়া কয়েকটি বড় ও উন্নত মানের ঘাট তৈরি করা হচ্ছে। বসার জন্য সিটিং ব্লক তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে ট্যুরিস্টরা বসে সময় কাটাতে পারবেন। এছাড়া ময়লা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় ডাস্টবিনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সেখানে পর্যটকসহ স্থানীয় দোকানিরা ময়লা ফেলবেন।’
ঝালকাঠির ভাসমান হাট
খাল দখল করছেন স্থানীয়রা ফেলা হচ্ছে প্লাস্টিক-পলিথিন
