মেহেদী হাসান: কৃষি খাতের উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিশেষায়িত খাতের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) প্রতিষ্ঠিত হলেও নিজেদের আর্থিক অবস্থা নিয়েই টানাটানিতে আছে ব্যাংক দুটি। বিপুল অঙ্কের মূলধন ঘাটতি, খেলাপি ঋণের উচ্চহার, উচ্চ সুদবাহী আমানতের ওপর অধিক নির্ভরশীলতা ও লোকসানি শাখা নিয়ে ধুঁকছে বিকেবি ও রাকাব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাত হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ছিল সাত হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। ছয় মাসের ব্যবধানেই মূলধন ঘাটতি বেড়েছে ৩৯০ কোটি টাকা। এছাড়া চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা; যার মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণই চার হাজার ২৬৪ কোটি টাকা।
এদিকে গত ছয় মাসে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়েছে ৭০ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটিতে মূলধন ঘাটতি ছিল ৭৪৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮১৩ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক হাজার ১৬২ কোটি টাকা।
জানা গেছে, বিকেবি ও রাকাবের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে ২০০৬-০৭ অর্থবছর থেকে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমওইউতে খেলাপি ঋণ আদায়, ঋণ প্রবৃদ্ধি যথাযথ রাখা, লোকসানি শাখা ও পরিচালন ব্যয় কমানো, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও সুপারভিশনের উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতি বছর একবার ব্যাংকগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে এসব লক্ষ্য অর্জনের মূল্যায়ন করা হয়। তবে বরাবরই ব্যাংক দুটি তাদের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষায়িত এই ব্যাংক দুটির মূলধন ঘাটতি পূরণে সরকারের ওপর নির্ভর না করে নিজেদের মুনাফা বৃদ্ধির মাধ্যমে তা পূরণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিকেবি ও রাকাব লোকসান গুনেছে। বাড়ছে ব্যাংক দুটির লোকসানি শাখার সংখ্যাও। বিকেবির এক হাজার ৩১টি শাখার মধ্যে ১৪৮টিই লোকসানি শাখা। এছাড়া রাকাবের ৩৭৯টি শাখার মধ্যে ১১৮টি লোকসানি শাখায় পরিণত হয়েছে।
জানতে চাইলে কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইসলামইল শেয়ার বিজকে বলেন, কৃষি ব্যাংকের ঋণের ৮২ শতাংশই কৃষকদের কাছে যায়, যাদের ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হয়। এখানে আমাদের ভর্তুকি দিতে হয়। এছাড়া নানা সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের অনেক ঋণ পুনঃতহবিল করা হয়েছে। সিডরের সময়ে সরকার অনেক ঋণ মওকুফ করে দিয়েছেন। তাই এই ব্যাংকের লোকসানের ক্ষেত্রে আমাদের কোনো দায় নেই। আমাদের ব্যাংকটিকে একটি সার্ভিস সেক্টর মনে করা হয়। আমরা জনগণকে নানা ধরনের সেবা দিয়ে থাকি। তিনি বলেন, অন্যান্য ব্যাংক খেলাপি ঋণ অবলোপন করলেও আমদের তেমন অবলোপন নেই। আমরা এ পর্যন্ত মাত্র ২৫০ কোটি টাকা অবলোপন করেছি। বর্তমানে যে পরিমাণ মূলধন ঘাটতি রয়েছে তা আজকের নয়। এটা ১৯৯১ সাল থেকে চলে আসছে।
সমঝোতা চুক্তির (এমওইউ) আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষায়িত ব্যাংক দুটিকে যেসব নির্দেশনা দিয়েছে তা হলো মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য শুধু সরকারের ওপর নির্ভর না করে ভবিষ্যতে আয় ও মুনাফা বৃদ্ধির মাধ্যমে মূলধন ঘাটতি পূরণে সচেষ্ট থাকা; ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা গাইডলাইনগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ এবং ঋণ নিয়মাচার মেনে ঋণ মঞ্জুরির জন্য পরিচালনা পর্ষদকে অধিক দায়িত্বশীল হতে হবে; শ্রেণিকৃত ঋণ আদায়সহ অন্য আর্থিক সূচকগুলোর ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জন করতে হবে। নতুন বিতরণকৃত ঋণ যাতে শ্রেণিকৃত না হয়, সে ব্যাপারে যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; শ্রেণিকৃত ঋণ আদায়ে সর্বাত্মক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে; আন্তশাখা লেনদেনের এন্ট্রিগুলো দ্রুত সমন্বয় করতে হবে; উচ্চ সুদবাহী আমানত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করার মাধ্যমে সুদ ব্যয় হ্রাস করতে হবে; ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ (২০১৩ পর্যন্ত সংশোধিত)-এ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী বাংলাদেশ ব্যাংকে দাখিল করতে হবে; কোর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইনগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন এবং কোর রিস্কের প্রতিটি সেগমেন্টের রেটিং ন্যূনতম সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে; লোকসানি শাখাগুলোকে লাভজনক শাখায় উন্নীতকরণের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নতুন শাখা খোলার আবেদন করতে হলে ক্যামেলস ও কোর রিস্ক রেটিংয়ের উন্নতি এবং অলাভজনক শাখার সংখ্যা হ্রাস করতে হবে; তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়াকে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে অটোমেশনের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপপূর্বক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অটোমেশন (সিবিএস পরিপূর্ণ বাস্তবায়নসহ) কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে।