কাজী সালমা সুলতানা: ৬ মার্চ ১৯৭১। ঢাকায় ষষ্ঠ দিনের মতো হরতাল পালনকালে সব জনতা রাস্তায় নেমে আসেন। হরতাল পালন শেষে তারই নির্দেশে বেলা আড়াইটা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক এবং যেসব বেসরকারি অফিসে এর আগে বেতন দেয়া হয়নি, সেসব অফিস বেতন প্রদানের জন্য খোলা রাখা হয়। এদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। ভাষণে তিনি বলেন, ‘যা-ই ঘটুক না কেন, যত দিন পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমার হুকুমে রয়েছে এবং আমি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আছি, তত দিন পর্যন্ত আমি পূর্ণাঙ্গ ও নিরঙ্কুশভাবে পাকিস্তানের সংহতির নিশ্চয়তা বিধান করব।’
প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের অব্যবহিত পরই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাখার ওয়ার্কিং কমিটির এক যৌথ জরুরি বৈঠক বসে। কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী এই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের আলোকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।
এদিন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। রাওয়ালপিন্ডিতে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলি ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণকে স্বাগত জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তার দল ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের আগেই আলোচনার মাধ্যমে শাসনতন্ত্রের একটি কাঠামো স্থির করতে চায়। লাহোর কাউন্সিলে মুসলিম লীগ নেতা এয়ার মার্শাল নূর খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, দেশ শাসনের বৈধ অধিকার শেখ মুজিবুর রহমানের রয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের সব বাধা অবিলম্বে দূর করতে হবে। প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণে পরিস্থিতির অবনতির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর দোষারোপ করায় নূর খান দুঃখ প্রকাশ করেন।
পেশোয়ারে পাকিস্তান মুসলিম লীগপ্রধান আবদুল কাইয়ুম খান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের সিদ্ধান্তকে অভিনন্দিত করে বিবৃতিতে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পিডিপি-প্রধান নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ও মুসলিম লীগ-প্রধান মিয়া মমতাজ দৌলতানা ইয়াহিয়া খানের ঘোষণাকে স্বাগত জানান। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেবজাদা ইয়াকুব আলী খানকে অপসারণ করে লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করেন। এ সময়ে নৃশংস ও কুখ্যাত হিসেবে পরিচিত টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানে গর্ভনর নিযুক্ত করাকে বাংলার মানুষ ভালোভাবে নিতে পারেনি। ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী টিক্কা খানকে শপথবাক্য পাঠ করাতে অস্বীকার করেন।
এদিন ছাত্রলীগ ও ডাকসু নেতারা এক বিবৃতিতে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাংলাদেশের সব বেতার কেন্দ্র থেকে রিলে করার দাবি জানান।
এদিন খুলনায় সেনাবাহিনীর গুলিতে ১৮ জন শহিদ ও ৬৪ জন আহত হন। চট্টগ্রামে আগের দিন বিহারি-বাঙালি শান্তি কমিটি গঠনের পরও ৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়তায় বিহারিরা ও পাকিস্তানপন্থি কিছু বাঙালি হিন্দুদের কৈবল্যধাম মন্দির লুণ্ঠন করে। এ সময় তারা স্থানীয় হিন্দু ও পুরোহিতদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করে। সেনাবাহিনী কর্তৃক শহিদ হওয়ার ঘটনা বিহারি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যারা উৎসাহিত হন। রেলওয়ে কলোনি, হালিশহর, আগ্রাবাদ ও নিউমার্কেট এলাকায় বাঙালি-বিহারির সংঘর্ষ হয়। সাধারণ বাঙালিদের সঙ্গে বিহারি-জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের সংঘর্ষ আন্দরকিল্লা, ফিরিঙ্গি বাজার, আছদগঞ্জ ও চকবাজারে ছড়িয়ে পড়ে।
তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর