Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 10:36 pm

খুলনার প্রথম দালানবাড়ি চার্লির ‘নীলকুঠি’

শেখ শান্ত ইসলাম, খুলনা: বন-জঙ্গল পরিপূর্ণ ইট সুরকির লাল দালান থেকে খসে পড়ছে পলেস্তরা। কোথাও কোথাও খসে পড়েছে দেয়ালের ইটও। ক্ষয়ে পড়ছে হার্ডবোর্ড। ভেঙে পড়েছে বাড়িটির দোতলায় ওঠার দুটি সিঁড়ির একটি। ২২১ বছরের পুরনো এই বাড়িটিই খুলনা শহরের প্রথম পাকা দালানবাড়ি। যেটি চার্লির ‘নীলকুঠি’ নামে পরিচিত।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৭৯৫ সালে ইংরেজ নীলকর বন্ড যশোরের রূপদিয়ায় প্রথম নীলের কারখানা স্থাপন করেন। এই কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে এ অঞ্চলে শুরু হয় অত্যাচারের এক ভয়ঙ্কর ইতিহাস। ১৮০১ সালে খুলনার দৌলতপুরে নীলকর এন্ডারসন প্রথম নীলকুঠি স্থাপন করেন। এরপর শহরের কেন্দ্রস্থল রেলওয়ে হাসপাতাল রোডে নীলকুঠি স্থাপন করা হয়। এই কুঠিটি স্থাপন করেন নীলকর চার্লস। আর এই কুটিবাড়িটিই খুলনা শহরের প্রথম পাকা দালানবাড়ি।

বাড়িটির অদূরেই ভৈরব নদ। নীলকর চার্লস তার বাড়ির পূর্বপাশে ভৈরব নদের তীরে একটি বাজার গড়ে তোলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষেরদিকে শহর হিসাবে খ্যাত হওয়ার আগে খুলনার পরিচিতি ছিল ‘চার্লিরহাট’ বা ‘সাহেবের হাট’কে ঘিরে। নীল কুঠিয়াল চার্লস এ বাজার প্রতিষ্ঠা করার কারণে তার নামেই নামকরণ করা হয় চার্লিগঞ্জ বা সাহেবের হাট। বর্তমানে ‘চার্লিগঞ্জ’ বা ‘সাহেবেরহাট’ এখন ‘বড়বাজার’ হিসাবেই পরিচিত।

চার্লি তার কুঠিবাড়ি থেকেই নীল চাষ এবং ‘সাহেবের হাট’ পরিচালনা করতেন। ওই সময় এ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে আরও অনেক নীলকুঠি ও নীলকরদের বাড়ি গড়ে ওঠে। এরমধ্যে চার্লির এ কুঠিবাড়িটি ছিল অন্যতম। অন্যান্য নীলকুঠির মতো চার্লির এ পাকা দালানবাড়িটি ছিল নীলকরদের কেন্দ্র। অনেকের মতে, তিনি ছিলেন স্থানীয় লবণ এজেন্সির প্রধান ইওয়ার্টের সহযোগী।

১৮৮৪ সালে কলকাতা থেকে খুলনা পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারিত হয়। তখন থেকে চার্লির বাড়িটি ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশন অ্যান্ড রেলওয়ে কোম্পানির (আইজিএনআরএসএন কোং) কার্যালয় হিসাবে ব্যবহৃত হতো। সে সময় ওই কোম্পানির এজেন্ট হিসাবে চার্লির বাড়িতে বসে দায়িত্ব পালন করেছেন ওয়ার্ডসন, নওয়াব হামিদ ইসমাইল, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী (পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী), খাজা গোলাম সরওয়ার ও এসআর দোহার মতো ব্যক্তিরা।

ভারত বিভক্তির পর নেভিগেশন ও রেলওয়েকে পৃথক করা হলে বাড়িটি নেভিগেশনের কার্যালয় হিসাবে ব্যবহার করা হতে থাকে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলে চার্লির বাড়িটিকে বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্পোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) আঞ্চলিক কার্যালয় করা হয়। পরে ২০০১ সালে এ বাড়িটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে খুলনা সিটি কর্পোরেশন।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৪৩ শতাংশ জমির ওপর দোতলা এই বাড়িটি ইট-বালি, চুন সুরকি, লোহার খাম্বা ও কাঠের পাটাতন দিয়ে নির্মিত। বাড়ির ছাঁদ নির্মাণ করা হয়েছে মাটির তৈরি টালি দিয়ে। টালির নিচেই রয়েছে হার্ডবোর্ড। বাংলো এই দোতলা বাড়িটির ওপরতলায় তিনটি ও নিচতলায় রয়েছে ৪টি কামরা। নিচ ও দোতলা কামরার সামনে আছে বড় খোলা বারান্দা। বারান্দায় কাঠ ও লোহার রেলিং। বাড়ির দোতলায় ওঠার জন্য পূর্ব-দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে রয়েছে দু’টি সিমেন্টের ঢালাই দেওয়া তৈরি সিঁড়ি।

নির্জন এ বাড়ির আঙিনায় রয়েছে আম, নারিকেল, খেজুর, মেহগনি গাছ ও সবুজ ঘাসের গালিচা। তবে বর্তমানে নিক্সন ও রেলওয়ে মার্কেটের ময়লা আবর্জনার ভাগাড় হিসেবে পরিণত হয়েছে বাড়ির আঙ্গিনা। ফাঁকা বাড়িতে বখাটে, ভাসমান মাদকসেবী ও বিক্রেতাদের নিরাপদ আড্ডা দিতে দেখা গেছে। যেখানে বিআইডব্লিউটিসি আঞ্চলিক কার্যালয়ের সাইনবোর্ড ছিলো সেখানে বাংলাদেশ রেলওয়ের সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে।

রেলওয়ে হাসপাতাল রোডের বাসিন্দা সুকুর আলী জানান, বাড়িটিতে বিআইডব্লিউটিসির একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী পরিবার-পরিজনসহ বসবাস করতেন। কিন্তু গত কয়েকমাস আগে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ তাদের ইজারা দেওয়া সম্পত্তি বুঝে নেওয়ায় বাড়িটি সিলগালা করে দেওয়া হয়। এ কারণে তারা বাড়িটি থেকে চলে যান। বর্তমানে ফাঁকা বাড়িটি মাদকসেবী ও বখাটেদের আড্ডার স্থান হয়েছে।

খুলনা রেলওয়ের কানুনগো মনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বিআইডব্লিউটিসিকে বাড়িটি লিজ দেওয়া হয়েছিল। দীর্ঘদিন লাইসেন্স ফি বকেয়া থাকায় ওটা আমরা দখলে নিয়ে সিলগালা করে দিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, সিলগালা করার পর আমাদের প্রকৌশল বিভাগের ওখানে বাউন্ডারি ওয়াল দেওয়ার কথা। স্যাংশন হয়ে গেছে। ঠিকাদারও নিয়োগ হয়ে কাজ শুরু হয়েছিল। পরে কী কারণে কাজ বন্ধ হয়েছে তা জানি না।