খুলনায় সোনালী ব্যাংকের চার শাখায় খেলাপি ঋণ ১২০০ কোটি টাকা

শুভ্র শচীন, খুলনা: রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক লিমিটেড খেলাপি ঋণের কারণে নাজুক অবস্থার মধ্যে পড়েছে। খুলনায় ব্যাংকের চারটি শাখা লোকসানি ও ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। শাখাগুলোয় খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। আর খেলাপি ঋণ আদায়ে উল্লেখ্যযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। অন্যদিকে আইনের নানা ফাঁকফোকরে ঋণখেলাপি পাট রফতানিকারকরা শুধু কালক্ষেপণ করছেন। শাখাগুলো হচ্ছে খুলনা করপোরেট শাখা, দৌলতপুর করপোরেট শাখা, দৌলতপুর কলেজ রোড শাখা ও খালিশপুর শাখা। খেলাপি তালিকার উল্লেখ্যযোগ্য প্রতিষ্ঠান খুলনা নিউজ প্রিন্ট মিলস।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশদ পরিদর্শন ও সোনালী ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। মোট ঋণের ৮৪ শতাংশ খেলাপি। অনিয়ম, প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণের নামে ব্যাংকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারাও অর্থ আত্মসাৎ করেছে। জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ লুটের সঙ্গে সোনালী ব্যাংকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সহযোগিতার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে খেলাপি ঋণের মধ্যে খুলনা করপোরেট শাখায় ৩৭০ কোটি টাকা, দৌলতপুর করপোরেট শাখায় ৪৭১ কোটি টাকা, দৌলতপুর কলেজ রোড শাখায় ৩৪৩ কোটি টাকা ও খালিশপুর শাখায় ৭২ কোটি টাকা।

সোনালী ব্যাংকের ডিজিএম শাহজাহান আলী শেখ জানান, খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো নীতিমালার আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। যারা এ আওতায় আসবে না তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি ইস্টার্ন ট্রেডিং নামক প্রতিষ্ঠান। খালিশপুর শাখার ম্যানেজার মফিজুল ইসলাম জানান, ১৪টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ৭২ কোটি টাকা দীর্ঘদিন বকেয়া হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য খেলাপি বাবুল জুট ট্রেডিং, পাপেন জুট ট্রেডিং। এদের বিরুদ্ধে এখনও মামলা করা হয়নি। নীতিমালার আলোকেই মামলা করা হবে।

দৌলতপুর কলেজ রোড শাখার ম্যানেজার জানান, ১৯ জন ঋণখেলাপিকে লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হয়েছে। অক্টোবরের মধ্যে নীতিমালার আওতায় না আসলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। জুলাই থেকে পাট মৌসুম শুরু হলেও এখনও ঋণদান প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।

সোনালী ব্যাংক খুলনার জিএম মো. মোশাররফ হোসেন জানান, ঋণ অনিয়মের অভিযোগে দুদক অনেক ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ঋণ অনিয়মের কারণে ব্যাংকের একসময়কার জিএম নেপাল সাহার বিরুদ্ধে মামলা ও তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তিনি এখন ব্যাংকের কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন। কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই না করে অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ দেওয়া হয়েছে।

মিরেরডাঙ্গার সোনালী জুট মিলের মালিক এস এম এমদাদুল হোসেন বুলবুল ৮৫ কোটি ৮০ লাখ ৬৯ হাজার টাকা সোনালী ব্যাংকের করপোরেট শাখা থেকে ঋণ নেন। ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহণ করে কাঁচাপাট না কিনে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে ওই পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেন, যা সুদাসলে ১২৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা দাঁড়িয়েছে। এ বছরের ২২ ফেব্রæয়ারি দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. মোশারফ হোসেন বাদী হয়ে খানজাহান আলী থানায় পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করেন। এ মামলার আসামিরা হলেন জুট মিলের মালিক এসএম এমদাদুল হোসেন বুলবুল, সোনালী ব্যাংক খুলনা করপোরেট শাখার ডিজিএম (বরখাস্ত) নেপাল চন্দ্র সাহা, অ্যাসিসট্যান্ট অফিসার কাজী হাবিবুর রহমান, সিনিয়র প্রিন্সিপল অফিসার শেখ তৈয়েবুর রহমান ও সাবেক ডিজিএম সমীর কুমার দেবনাথ।

মিরেরডাঙ্গা এলাকায় ১৯৬৮ সালে স্থাপিত এ মিলটি ৭২ সালের জাতীয়করণ করা হয়। লাভজনক না হওয়া ১৯৮৩ সালে বিরাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে ইসলাম গ্রæপ অপ ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৯৯৮ সালে আবার মালিকানা পরিবর্তন হয়। চেয়ারম্যান এস এম এমদাদুল ইসলাম বুলবুল এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর লিয়াকত হোসেন মিল পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছেন। এ আত্মসাৎ মামলা স্থানীয় সিএমএম আদালতে বিচারাধীন। আদালত মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যদিকে ৮২ কোটি টাকা পাওয়া আদায়ের জন্য উত্তরা ব্যাংক স্যার ইকবাল রোড শাখা সোনালী জুট মিলের পাঁচজনের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছে।

৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা আত্মসাৎ নগরীর বিকে রায় রোডের মৃত সোহরাব আলীর ছেলে মেমার্স ভিভা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক এস এম মনিরুল ইসলাম ময়না ও জনতা ব্যাংক খুলনা করপোরেট শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার (অব.) এমএ বারীর বিরুদ্ধে ব্যাংকের এজিএম মনোয়ারা খাতুন বাদী হয়ে খুলনা থানায় মামলা করেন। এ মামলায় উল্লিখিত দুজনের বিরুদ্ধে ব্যাংকের ৯ কোটি ৫০ লাখ ২০ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। ২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট দুদকের সহকারী পরিচালক এস এম শামীম ইকবাল চার্জশিটে উল্লেখ করেন, আমদানিকারক মনিরুল ইসলাম ১৯৯৯ সালের ২৮ জুন জনতা ব্যাংক করপোরেট শাখার মাধ্যমে ইউনাইটেড আরব আমিরাত থেকে জিটিএসপি সার আমদানির জন্য এলসি খোলেন। এলসির বিপরীতে মেমার্স নেগালফ ইন্টারন্যাশনাল দুবাইয়ের অনুক‚লে জনতা ব্যাংক খুলনা করপোরেট শাখা দুবাইয়ের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে উল্লিখিত পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করে। আমদানিকারক মনিরুল ইসলাম যোগসাজশে ব্যাংক কর্মকর্তা এমএ বারীকে সুবিধা দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে মাল খালাস করে সমুদয় টাকা আত্মসাৎ করেন।

চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে, আমদানিকারক ব্যাংকের পাওনা টাকা পরিশোধ করেননি। মামলাটি মহানগর দায়রা জজ চার্জশিট গ্রহণ করে বিভাগীয় বিশেষ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়েছে। আসামিরা জামিনের পর কিছুদিন পলাতক থাকায় আদালত তাদের হাজির হওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সরকারপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মুজিবর রহমান জানান, আমদানিকারক মনিরুল ইসলাম গত ২ অক্টোবর আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করলে তা না-মঞ্জুর হয়। গত মঙ্গলবার আবারও আবেদন করলে আদালত জামিন না-মঞ্জুর করেন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০