Print Date & Time : 23 June 2025 Monday 9:54 am

খুলনা অঞ্চলে বাড়ছে বিনিয়োগ

 

শুভ্র শচীন, খুলনা: বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) খুলনার তথ্য অনুযায়ী, খুলনাঞ্চলে আট বছরের ব্যবধানে শিল্পে বিনিয়োগ বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। পদ্মা সেতু নির্মাণ ও মোংলা বন্দর গতিশীল হওয়ায় গোটা দক্ষিণাঞ্চলে ফুড অ্যান্ড অ্যালাইড প্রডাক্টস, প্রকৌশল শিল্প, পাট ও বস্ত্র শিল্প, গার্মেন্টস, প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, সিরামিক ও ট্যানারি, ফ্লাক ডোর নির্মাণ, বৈদ্যুতিক মিটার ও যন্ত্রাংশ নির্মাণ, তৈজসপত্র, গ্যাস অ্যাম্পুলসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। নতুন নতুন শিল্প-কলকারখানা স্থাপনের জন্য শিল্পোদ্যোক্তারা এ অঞ্চলে জমি খুঁজছেন।

সম্প্রতি খুলনায় গ্যাস এসেছে। নগরীর আড়ংঘাটায় সিজিএস (চাপ নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র) এ গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে খুলনাবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হলো। তবে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রাথমিকভাবে এই গ্যাস সংযোগ দেওয়া হবে পিডিবির কয়েকটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে।

এ বিষয়ে সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার খালিকুজ্জামান জানান, খুলনায় গ্যাস এসেছে। তবে এই গ্যাস প্রাথমিকভাবে শুধু বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় সংযোগ দেওয়া হবে। খালিশপুরে ২২৫ ও ৩০০ মেগাওয়াটের দুটি এবং রূপসায় ৮০০ মেগাওয়াটের একটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে সংযোগের জন্য পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হবে। এ তিনটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রই পিডিবির।

বিডা খুলনা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় শিল্পে বিনিয়োগ হয়েছিল মাত্র ২৩৮ কোটি টাকা। এরপর থেকেই প্রতি বছর এ বিনিয়োগ বাড়তে থাকে। ২০১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ৩৩৪ কোটি টাকায়। এক্ষেত্রে প্রথম অবস্থানে রয়েছে বাগেরহাট জেলা, এরপর খুলনা। তবে ১০ জেলার মধ্যে কিছুটা নাজুক অবস্থায় রয়েছে নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলা।

জানা যায়, গত ১২ বছরে খুলনায় ৩০১টি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ বোর্ডে নিবন্ধিত হয়েছে। এক্ষেত্রে ফুড অ্যান্ড অ্যালাইড প্রডাক্টস উৎপাদনের জন্য নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ খাতে ৬০টি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন নিয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে প্রকৌশল শিল্প। এ খাতে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪৯টি। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে পাট ও বস্ত্রশিল্প, যেখানে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪৩টি। নিবন্ধন নিয়েছে গার্মেন্টস এক্সপোর্ট হাউজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তৈরি পোশাক রফতানিকারক এ প্রতিষ্ঠানটি যশোরে তাদের কারখানা স্থাপন করেছে।

‘বিজি ব্যাক টাইগার’ নামে দেশের সবচেয়ে বড় আধানিবিড় চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন হচ্ছে নগরীর নতুনবাজার লঞ্চঘাট এলাকায়। ফুলতলার উত্তরডিহীতে ‘সুপার অ্যান্ড লেদার লিমিটেড’ নামে কার্যক্রম শুরু করেছে একটি চামড়া প্রক্রিয়াজাত ও রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান। বাগেরহাটের কাটাখালীতে প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে যাত্রা শুরু করেছে ‘মুন স্টার সিরামিক’। প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের দুটি কারখানা হচ্ছে রূপসায়। এসবের পাশাপাশি ফ্লাক ডোর নির্মাণ, বৈদ্যুতিক মিটার ও যন্ত্রাংশ নির্মাণ, তৈজসপত্র, গ্যাস অ্যাম্পুলসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে এ অঞ্চলে। চলতি বছর দাকোপের পানখালীতে বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস যৌথ উদ্যোগে এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডারকরণ প্রকল্পের নিবন্ধন হয়েছে।

সরেজমিন খুলনা-মোংলা সড়কের মোংলা বন্দরসংলগ্ন ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রাস্তার দুই পাশের জমিতে বড় বড় শিল্প গ্রুপের সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। রূপসা সেতুর দুই পাশের জমি শিল্পোদ্যোক্তারা কিনে নিয়েছেন আরও অনেক আগেই। খুলনা-বাগেরহাট সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকেই খুলনা অঞ্চলের জমির হাতবদল বেড়েছে। বড় বড় শিল্প গ্রুপ মোংলা-রামপালসহ আশপাশ এলাকায় জমি কিনছে। এদের মধ্যে ওরিয়ন গ্রুপ, আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ, করিম গ্রুপ, মীর গ্রুপ, ইনডেক্স গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ, নাভানা গ্রুপ, সুন্দরবন শিপইয়ার্ড, কেডিএস লজিস্টিকস, বিকন এলপিজি, উত্তরা মোটরস করপোরেশন, মোংলা সিমেন্ট, ফ্রেশ শিপইয়ার্ড, লিথি গ্রুপ, সানমেরিন শিপইয়ার্ড, সাইফ শিপবিল্ডিং, মাহবুব ব্রাদার্স লিমিটেড, ফমকম গ্রুপ রয়েছে।

এরই মধ্যে এ এলাকায় শিল্প স্থাপন করেছে বসুন্ধরা গ্রুপ, হোলসিম সিমেন্ট, ওমেরা পেট্রোলিয়াম, দুবাই বাংলাদেশ সিমেন্ট ও ব্যাগ ফ্যাক্টরি, পিটার পেট্রোলিয়াম। এ অঞ্চলের উন্নয়নের পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানের আরও ব্যবসা প্রসারের পরিকল্পনা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

বিনিয়োগকারীরা মনে করেন, দ্রুত পাইপলাইনে গ্যাস বিতারণ শুরু হলে এ অঞ্চলে আরও দ্রুততার সঙ্গে নতুন নতুন শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠবে। তাদের মতে, খুলনাঞ্চলে বিনিয়োগ করার জন্য অবকাঠামোসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শাহনেওয়াজ নাজিমুদ্দিন বলেন, সম্ভাবনা থাকলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সম্পদের অভাব এখানকার শিল্পায়নে প্রধান প্রতিবন্ধক। তিনি বলেন, খুলনার রূপসা নদীর তীর ঘেঁষে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ফ্রোজেন ফুড ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে। এ ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। খুলনা, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলায় হালকা প্রকৌশল শিল্পের বিকাশ ঘটেছে।

বিডার খুলনা বিভাগীয় পরিচালক নিরঞ্জন কুমার মণ্ডল বলেন, এ অঞ্চলে শিল্পায়নের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে শিল্পায়ন বাড়াতে হলে পাইপলাইনে দ্রুত গ্যাস বিতারণ ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং বিমানবন্দর নির্মাণ জরুরি। গ্যাস বিতারণ শুরু হলে পণ্যের উৎপাদন খরচ কমবে এবং বিমানবন্দর নির্মিত হলে বিনিয়োগে আগ্রহীরা দ্রুত যাওয়া-আসা করতে পারবেন।

বিডা চেয়ারম্যান কাজী মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, খুলনা বিনিয়োগের জন্য অপার সম্ভাবনাময় একটি অঞ্চল। এখানে প্রাকৃতিক সম্পদ, কাঁচামাল, সহজলভ্য শ্রম ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ রয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের সহজে আকর্ষণ করতে সক্ষম। সরকার বেনাপোল-ঢাকা ও পায়রা-ঢাকা রুটে শিল্প করিডোর গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। বিষয়টি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখবে।

খুলনা চেম্বারের পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে মোংলা বন্দরে গতি ফিরে আসায় খুলনাঞ্চলে বিনিয়োগ বাড়ছে। শিল্পোদ্যোক্তারা এ অঞ্চলে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। বিমানবন্দর এবং পাইপলাইনে দ্রুত গ্যাস বিতারণ শুরু হলে এ অঞ্চলে আরও নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে।

খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান এমপি বলেন, শেখ হাসিনা সরকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নে আন্তরিক। ইতোমধ্যে সরকার এ অঞ্চলের উন্নয়নে ব্যাপক প্রকল্প গ্রহণ করেছে। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ চলছে। মোংলা বন্দরেও গতি ফিরেছে। তিনি জানান, মোংলায় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন ও খুলনা-মোংলা রেললাইন নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে বিনিয়োগের সুযোগ আরও বাড়বে। এতে বিনিয়োগকারীরা এ অঞ্চলে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে আগ্রহী হবেন।