খেজুর রস আহরণে ব্যস্ত লক্ষ্মীপুরের গাছিরা

পৌষের মাঝামাঝি চলছে। রস আহরণে ব্যস্ত সময় পার করছেন লক্ষ্মীপুরের মৌসুমি গাছিরা। শীতকে কেন্দ্র করে খেজুর গাছের গুরুত্ব বাড়লেও এ অঞ্চলে অতীতের মতো বাড়ির আশপাশ ও সড়কের পাশে খেজুর গাছের দীর্ঘ সারি দেখা যায় না। খেজুর গাছ কমে যাওয়ায় অনেকে গুটিয়ে নিয়েছেন তাদের এ ব্যবসা। গাছিদের কাজ না থাকায় তারা ঝুঁকছেন অন্য পেশায়। তবু শীত মৌসুমের শুরুতে খেজুর গাছ থেকে রস আহরণে ব্যস্ত সময় পার করছেন এ অঞ্চলের মৌসুমি গাছিরা।
জানা যায়, এ মৌসুমে রস আহরণ ও বিক্রি করে অনেকে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। রস আহরণের জন্য অগ্রহায়ণের শুরু থেকেই খেজুর গাছ পরিষ্কারের কাজ শুরু করা হয়। গাছ থেকে রস আহরণ করতে প্রথমে গাছের মাথার অংশ পরিষ্কার করতে হয়। পরে বিশেষ কায়দায় অল্প কেটে সাদা অংশে বাঁশের নল ও গাছের বুক চিরে ছোট দুটি খুঁটি গেড়ে তাতে ছোট-বড় মাটির কলসি ঝুলিয়ে রস আহরণ করা হয়। গাছ পরিষ্কারের ১৫ দিন পর থেকে রস পাওয়া যায়। রসের ধারা চলতে থাকে ফাল্গুন পর্যন্ত। শীত যত বেশি পড়বে, রসের স্বাদ তত মিষ্টি হবে। গাছ কাটার পর দু-তিন দিন রস পাওয়া যায়। প্রথম দিনের রসকে বলে জিরান বা এক কাটা। প্রথম দিনের রস থেকে ভালো পাটালি গুড় তৈরি হয়। দ্বিতীয় দিনের রসকে বলে দোকাটা। তৃতীয় দিনের রসকে বলে তেকাটা। রসের জন্য খেজুর গাছে একবার কাটার পর আবারও পাঁচ-ছয় দিন পর কাটতে হয়। গাছের কাটা অংশ শুকানোর জন্য এ সময়টুকুর প্রয়োজন। কাটা অংশ শুকানোর সুবিধার জন্যই সাধারণত পূর্ব ও পশ্চিম দিকে গাছ কাটা হয়, যাতে সূর্যের আলো সরাসরি কাটা অংশে পড়ে।
গাছ থেকে রস আহরণের জন্য সাধারণত মাটির হাঁড়ি ব্যবহার করা হলেও বর্তমানে অনেকে প্লাস্টিকের পাত্র ব্যবহার করেন। গাছিরা বিকালে খেজুর গাছে হাঁড়ি দেন। বিকাল থেকে ভোর পর্যন্ত হাঁড়িতে ফোঁটায় ফোঁটায় জমে থাকা রস আহরণে সকালে প্রচণ্ড শীত আর ঘন কুয়াশার মধ্যে গাছ থেকে রসের হাঁড়ি সংগ্রহ করেন গাছিরা। পরে সংগ্রহ করা রস গাছিরা বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করেন। সাধারণত একটি খেজুর গাছ রস দেওয়ার উপযোগী হতে পাঁচ থেকে ১০ বছর লাগে। স্থানভেদে একটি খেজুর গাছে মাসে ৪০ থেকে ৫০ কেজি রস পাওয়া যায়।
সদর উপজেলার দত্তপাড়া, উত্তর জয়পুর, বশিকপুর, কমলনগর উপজেলার তোরাবগঞ্জ, চর কালকিনিসহ জেলার কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বছর দুয়েক আগেও যেখানে খেজুর গাছ ছিল, আজ সেখানে বসতঘর কিংবা পাকা সড়ক হয়েছে। অবশ্য দুই-একটি স্থানে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। রস আহরণের জন্য পড়ন্ত বিকালে খেজুর গাছে কলসি কিংবা প্লাস্টিকের বোতল বাঁধার জন্য গাছিদের প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়। গাছের সংখ্যা ও রস উৎপাদন কমে যাওয়ায় কয়েকটি স্থানের গাছিরা এখন কৃষিকাজ এবং ফেরি করে মাছ ও তরকারি বিক্রি করে সংসার চালান।
কথা হয় কমলনগর উপজেলার চর কালকিনি গ্রামের বলির পোল এলাকার গাছি আবু মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, বাবার কাছ থেকে খেজুর রস আহরণের কৌশল শিখেছি। এ পেশার ওপর নির্ভর করেই একসময় তার পরিবার চললেও এখন আর তা হয়ে ওঠে না। গত বছর ৪০টি গাছ চুক্তিতে ও নিজের পাঁচটি গাছসহ মোট ৪৫টি গাছ থেকে তিনি রস আহরণ করেন। কিন্তু এ বছর নদীভাঙনে তার নিজের পাঁচটি গাছ বিলীন হয়ে গেছে। এ বছর ২৫টি গাছ তিনি চুক্তিতে নিয়েছেন। চলতি মৌসুমে তিনি অগ্রহায়ণের মাঝামাঝিতে গাছ পরিষ্কারের কাজ শুরু করেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আবুল হোসেন জানান, সভ্যতার ক্রমবর্ধমান বিকাশে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য খেজুর গাছ ক্রমে বিলুপ্ত হচ্ছে। কিন্তু যে হারে খেজুরগাছ নিধন হচ্ছে, সে তুলনায় এ গাছ রোপণ করা হয় না। তাই খেজুরের রস ও গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে কৃষককে জমির আইলের পাশে খেজুর গাছ লাগানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

জুনায়েদ আহম্মেদ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০