Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 10:17 pm

খেলাপিরা সুবিধায় ব্যাংক অসুবিধায়

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: বন্দর সুবিধার কারণে চট্টগ্রামে ভারী শিল্প বিশেষত ইস্পাত, সিমেন্ট, জাহাজ ভাঙা, জাহাজ নির্মাণ শিল্প, পোশাক কারখানা ও ওষুধসহ বড় বড় ট্রেডিং হাউস গড়ে উঠেছে। কিন্তু নানা জটিলতায় বেশ কিছু ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ব্যাংকে খেলাপি হয়ে পড়ে। পাওনা আদায়ে ব্যাংক অর্থঋণ আদালতে মামলা করলেও নানা সীমাবদ্ধতায় দ্রুত সময়ে মামলা নিষ্পত্তি হয় না। এতে গ্রাহক দেনা পরিশোধে অনেক সময় পেলেও ব্যাংকের পাওনা আটকে থাকে বছরের পর বছর।

তথ্যানুযায়ী, করোনা মহামারিতে ২০২১ সালে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে মোট এক হাজার ২৩৪টি মামলা দায়ের হয়। এর মধ্যে অর্থঋণ মামলা রয়েছে ৯০৫টি, অর্থ জারি মামলা ২৬৯টি এবং অর্থ মিস মামলা রয়েছে ৬০টি। একই সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ৭৯৯টি মামলা। এর মধ্যে অর্থঋণ মামলা রয়েছে ৫১৯টি, জারি মামলা ২৩০টি এবং মিস মামলা রয়েছে ৫০টি। অর্থাৎ প্রতি কর্ম দিবসে গড়ে পাঁচটির বেশি খেলাপি মামলা হয়েছে। বিপরীতে নিষ্পত্তি হচ্ছে মাত্র তিনটি করে মামলা।

জানা যায়, অর্থঋণ আদালতে বর্তমানে চলমান মামলা রয়েছে ৫ হাজার ১৬২টি। এর মধ্যে তিন থেকে ছয় মাস ধরে বিচার কার্য চলছে এক হাজার ৫৪৭টি মামলার। ছয় মাস থেকে ১২ মাস ধরে ৬৬৬টি মামলা, এক বছর ধরে ৩৫৩টি মামলা এবং দুই বছর ধরে কার্যক্রম চলছে ৩৭৬টি মামলা। এ ছাড়া অন্যান্যভাবে ঝুলে রয়েছে ২ হাজার ২২০টি মামলা। এসব তথ্য চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালত থেকে পাওয়া গত বছরের বার্ষিক হিসেবে উঠে এসেছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও বাণিজ্যিক ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারের দরপতন, স্থানীয় বাজারের প্রতিযোগিতা, উদ্যোক্তাদের দূরর্শিতার অভাবে লোকসানের পড়েন বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ট্রেডিং খাত অর্থাৎ ভোগ্যপণ্য (গম, খাদ্যদ্রব্য, ভোজ্যতেল ও রিফাইনারি) আমদানিকারক, জাহাজ ভাঙ্গা, জাহাজ নির্মাণ শিল্প ইত্যাদি। ফলে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি হয়ে পড়েন এসব ব্যবসায়ী।

তাদের আবার ব্যবসায় সুযোগ দেওয়ার জন্য ২০১৯ সালে ১৬ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি’ বিভাগ ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা জারি করে। এ নীতিমালায় স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্দমানের ঋণখেলাপিরা বিশেষ এ সুবিধা পাবেন। অর্থাৎ সব খেলাপির জন্যই বিশেষ সুবিধা রাখা হয়েছে। পুনঃতফসিলের পর ঋণখেলাপিরা নিতে পারবেন নতুন ঋণও। এসব সুযোগ-সুবিধা পেতে ৯০ দিনের মধ্যে আবেদন করার সুযোগ রাখা হয়েছিল।

নীতিমালা অনুযায়ী, খেলাপিরা ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে সর্বোচ্চ ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিল সুবিধা পাবেন। কেস টু কেস বিবেচনায় ঋণ পরিশোধে এক বছরের জন্য গ্রেস পিরিয়ডও পাওয়া যাবে। অর্থাৎ প্রথম এক বছরে খেলাপিদের ঋণের কোনো কিস্তি পরিশোধ করতে হবে না। মওকুফ হবে অনারোপিত সুদের সম্পূর্ণ অংশ ও ইন্টারেস্ট সাসপেন্সেস হিসাবে রক্ষিত সুদও।

নীতিমালায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবেন ট্রেডিং (গম, খাদ্যদ ব্য, ভোজ্যতেল ও রিফাইনারি), জাহাজ শিল্প, লোহা ও ইস্পাত শিল্প খাতের ঋণখেলাপিরা। এসব খাতের খেলাপি গ্রাহকরা সরাসরি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পাবেন।

অন্য খাতের ঋণখেলাপিদের পুনঃতফসিল সুবিধা পেতে ব্যাংকের বিশেষ নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। এ সুবিধায় আবারও পুরোদ্দমে ব্যবসায় ফিরে আসার আশা সঞ্চার হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের মধ্যে। এ সুবিধার আবারও বাড়ানো হয়েছে।

এ বিষয়ে আইনজীবী সরওয়ার কামাল বলেন, ঋণখেলাপি সংক্রান্ত মামলা পরিচালনার জন্য চট্টগ্রামে মাত্র একটি কোর্ট আছে। অথচ ঢাকায় আছে পাঁচটি আদালত। আবার অনেক সময় গ্রাহক ও ব্যাংক পারস্পরিক সমঝোতার কারণে কিংবা রিটের কারণে মামলার কার্যক্রম ধীর গতিতে চলে। ফলে মামলা জট থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আদালতের সংখ্যা বাড়াতে হবে। অন্যথায় এ সমস্যার সমাধান হবে না। এতে গ্রাহক পাওনা পরিশোধে সুবিধা পেলেও ব্যাংক পাওনা আদায়ে অসুবিধা পড়ে।

নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক এক শিল্প গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, আমরা ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি নই। আমরা চেষ্টা করছি ঘুরে দাঁড়ানোর। কিন্তু বারবার আটকে যাচ্ছি। আমাদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ছাড়া সব আছে। কিন্তু রি-শিডিউল করলেও ব্যাংকগুলো নতুন করে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বা এলসি ওপেন করার জন্য ব্যাংকগুলো নতুন করে ঋণ দিচ্ছে না। তাহলে আমরা কীভাবে ব্যবসা করব? দরকার হলে ব্যাংকের প্রতিনিধি আমাদের ব্যবসা তদারকি করবেন। তবুও আমরা ব্যবসা করতে চাই। এমনকি আমরা সম্পত্তি বিক্রয়ের উদ্যোগ নিলেও আগ্রহী ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না বা ক্রেতা পেলেও দাম কম ইত্যাদি সমস্যা আছে।

একাধিক ব্যাংকের কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রাম অঞ্চলের বেশ কিছু শিল্পগ্রুপের ব্যবসায় ফিরে আসার সুয়োগ আছে। তাদের যে পরিমাণ জমি বা অন্যান্য সম্পদ আছে তা বিক্রয় করে কিংবা একাধিক কারখানার মধ্যে কিছু বা একটি বিক্রয় করে দিয়ে সহজে রি-শিডিউল করে আবারও ব্যবসায় নিয়মিত হতে পারে। যদিও করোনার কারণে জমির প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ও দাম কম। আবার রিটের কারণে মামলা সহজে নিষ্পত্তি হচ্ছে না। সবমিলিয়ে ব্যাংকের পাওনা আটকে আছে বছরের পর বছর।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ খেলাপি ঋণের হালনাগাদ তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। অপরদিকে সর্বশেষ ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ৯ শতাংশ সুদহারে ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধার সময়সীমা বৃদ্ধি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আরও ৯০ দিন সময় পাবেন আবেদনকারীরা। এ সুবিধায় ঋণ পুনঃতফসিল করে ইতোমধ্যেই প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা হয়েছে।