রোহান রাজিব: কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ আড়াল করতে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন বা রাইট অফ পদ্ধতি বেছে নিয়েছে। ফলে প্রতিনিয়ত অবলোপনকৃত ঋণ বাড়ছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে অবলোপন করা ঋণের পুঞ্জীভূত স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৭৮১ কোটি ৫১ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, অনেক ব্যাংক আর্থিক প্রতিবেদন পরিষ্কার রাখতে খেলাপি ঋণ কমানোর সহজ পন্থা হিসেবে অবলোপনকে বেছে নিয়েছে। খেলাপি ঋণ আদায় জোরদারের চেয়ে তারা মনোযোগ দিচ্ছে অবলোপনের দিকে, যা কোনো ভালো সমাধান নয়। কারণ যে পরিমাণ অবলোপন বা ‘রাইট অফ’ করা হয়, সে পরিমাণ আদায় হয় না। ঋণ আদায় না করে যদি অবলোপন বা ‘রাইট অফ’ কৌশল বেছে নেয়া হয়, তাহলে একসময় ব্যাংকের মূলধনও শেষ হয়ে যায়। তাই এটা ভালোভাবে দেখার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে নতুন করে ঋণ অবলোপন হয়েছিল ৩৭৯ কোটি ৯ লাখ টাকা। ফলে অবলোপন করা ঋণের পুঞ্জীভূত স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৭৮১ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এ তিন মাসে আদায় হয়েছে ১৮২ কোটি টাকা। এতে করে সুদসহ মোট আদায়ের পরিমাণ ১৭ হাজার ২২৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এ অঙ্ক বাদ দিলে অবলোপনকৃত ঋণের স্থিতি ৪৩ হাজার ৫৫৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। আর ওই সময় পর্যন্ত ব্যাংকের স্থিতিপত্রে থাকা খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। অবলোপন করা ঋণ যোগ করলে খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় এক লাখ ৭৭ হাজার ৯৫৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর পুঞ্জীভূত অবলোপনের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে আছে ২৩ হাজার ২১১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এ পরিমাণ ঋণ থেকে ব্যাংকগুলো আদায় করতে সক্ষম হয়েছে পাঁচ হাজার ৩৯৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকে অবলোপনকৃত ঋণ ৬৩৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তাদের আদায় ৩৫৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে অবলোপন ৩৫ হাজার ৪৭৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এ খাতের ব্যাংকগুলো আদায় করতে সক্ষম হয়েছে ১১ হাজার ২১০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। আর বিদেশি ব্যাংকে এক হাজার ৪৫৬ কোটি ২ লাখ টাকা অবলোপন দাঁড়ায়। এসব ব্যাংকের আদায় ২৫৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
প্রতিবেদনে অনুযায়ী, জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর তুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন বেশি করেছে। তিন মাসে ৩৭৯ কোটি ৯ লাখ টাকার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করেছে ৩২৮ কোটি টাকা। অপরদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণ অবলোপনের মাত্র ২ লাখ টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো এ সময়ে ঋণ অবলোপন করেছে ৩৩ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপনের অঙ্ক ১৭ কোটি টাকা।
অবশ্য এর আগের প্রান্তিক (এপ্রিল-জুন) রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর তুলনায় বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ
অবলোপনের প্রতিযোগিতায় অনেক এগিয়ে ছিল। তিন মাসে ৫৪৪ কোটি ১৩ লাখ টাকার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করেছে ৭৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অপরদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণ অবলোপনের অঙ্ক ৪৫৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো এ সময়ে ঋণ অবলোপন করেছে ১০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। দেশে কার্যরত বিদেশি ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপনের অঙ্ক ৫৩ লাখ টাকা। এছাড়া গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ঋণ অবলোপন হয়েছিল ৫২৯ কোটি টাকা।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) সময়ে এক হাজার ৪৫২ কোটি ৭০ লাখ টাকা অবলোপন করে ব্যাংকগুলো। এ সময়ে আদায় হয়েছে ৭৪৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
ব্যাংক ব্যবস্থায় মন্দ মানে শ্রেণিকৃত খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রেখে স্থিতিপত্র থেকে বাদ দেয়াকে ঋণ অবলোপন বলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে ২০০৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করে আসছে। ঋণগ্রহীতা পুরো টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হন। তবে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হিসেবে তা দেখানো হয় না।
জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে খেলাপি ঋণ অবলোপনের নীতিমালা শিথিল করা হয়েছে। আগে মামলা ছাড়া দুই লাখ টাকা পর্যন্ত খেলাপি ঋণ অবলোপন করা যেত। এখন থেকে অর্থঋণ আদালতে মামলা ছাড়াই পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ অবলোপন করা যাবে। ঋণের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে মামলা খরচ বেশি হয়। এ বিবেচনায় ব্যাংকগুলোর ছোট ঋণ অবলোপনে এমন সুযোগ দিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ঋণ অবলোপনের নতুন শিথিলতা বড় কোনো বিষয় না। ছোট ঋণ অবলোপনের জন্য এ সুযোগ দেয়া হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংক খাতের একটা ঝামেলা কমবে।
তিনি আরও বলেন, নতুন সিদ্ধান্তে অবলোপনকৃত ঋণ আদায় বাড়বে না। কারণ ছোটরা কিছু টাকা দিলেও বড়রা টাকা দিচ্ছে না। কিন্তু এসব প্রভাবশালীদের থেকে টাকা আদায়ে আইনি কাঠামোতেও বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাই অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে সুশাসন ফেরাতে হবে।