খেলাপির লাগাম টানতে রোডম্যাপ

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ ব্যাংক নানা ধরনের ছাড় দিয়েও দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে সফল হয়নি। বরং এসব ছাড়ের সুযোগ পেয়ে খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে। তবে এবার খেলাপি ঋণ কমাতে ও ইচ্ছাকৃত খেলাপির বিরুদ্ধে কঠোর হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য এরই মধ্যে ১১টি কর্মপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।

এসব কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আগামী ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ আট শতাংশের নিচে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে সীমার বাইরে দেয়া ঋণ, বেনামি স্বার্থসংশ্লিষ্ট ঋণ এবং জালিয়াতি/প্রতারণার মাধ্যমে দেয়া ঋণ কমিয়ে শূন্যে আনতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক।

গতকাল রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের ৪২৩তম সভায় এসব কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। পরিচালক পর্ষদ তা অনুমোদনও দিয়েছে। পরিচালক পর্ষদের সভা শেষে এসব বিষয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের।

ডেপুটি গভর্নর জানান, ব্যাংক খাতের খেলাপি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড সভায় একটি রোডম্যাপ তুলে ধরা হয়। কর্মপরিকল্পনাটি সময়ভিত্তিক ও ফলাফল টার্গেট বেজ। এক্ষেত্রে তিনটি টার্গেট নিয়ে আগামী ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত সময় নেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে আট শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার পরিল্পনা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে পাঁচ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার কর্মপরিকল্পনা করা হয়। নতুন রোডম্যাপের মাধ্যমে খেলাপি কমবে বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই শীর্ষ কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের স্থিতি রয়েছে এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

খেলাপি কমাতে ১১টি কর্মপরিকল্পনা: ২০২৬ সালের মধ্যে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ আট শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে মন্দঋণ অবলোপনের সময় তিন বছর থেকে কমিয়ে দুই বছর করা হবে। এক্ষেত্রে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হবে। এই পদক্ষেপের কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে ৪৩ হাজার ৩০ কোটি বা ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ হ্রাস পাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, শতভাগ প্রভিশন রাখলে ব্যাংকের কোনো ঝুঁকি তৈরি হবে না।

এছাড়া অবলোপন ঋণ আদায়ে ব্যাংক নির্বাহীদের সরাসরি যুক্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ‘অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিট’ নামে একটি পৃথক ইউনিট গঠন এবং ঋণ আদায় নির্বাহীদের মূল্যয়ন যুক্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মপরিকল্পনায় বেসরকারি খাতে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় আইন প্রণয়নের কথাও বলা হয়। এতে মন্দ ঋণ এবং অবলোপনকৃত সম্পদ বেসরকারি খাতে অ্যাসেস ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির (এএমসি) কাছে বিক্রি করে ব্যাংক তাদের ব্যালেন্স শিট পরিষ্কার করতে পারবে। এই অর্থ ব্যাংকের আয় খাতে জমা করতে পারবে।

খেলাপি ঋণ কমাতে অন্যতম কঠোর পদক্ষেপ হলো ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে প্রকৃত আদায় ছাড়া সুদ অথবা মুনাফা আয় খাতে নেয়া যাবে না। প্রকৃত আদায় না হওয়া পর্যন্ত আলাদা ব্যালেন্স শিটে রাখতে হবে। ফলে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নিয়মিত ঋণকে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ হতে দেবে না বলে মত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মপরিকল্পনায় আরও বলেছে, এর আগে ঋণ পরিশোধে বিভিন্ন ছাড় দেয়া হয়েছে। এসব ছাড়ের মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না। এতে ঋণ পরিশোধের সংস্কৃতি ফিরে আসবে এবং ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট কমে আসবে। আর ক্যাশফ্লো বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি পুরোনো ঋণ আদায়ের মাধ্যমে বেসরকারি খাতে নতুন ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে।

অন্যদিকে মেয়াদি ঋণের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার সময় আন্তর্জাতিক চর্চায় ফিরিয়ে আনা হবে। এক্ষেত্রে সব ধরনের মেয়াদি ঋণ ওভারডিউ হওয়ার পর পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে খেলাপি করতে হবে, যা বর্তমানে নয় মাসে করা হয়। এতে খেলাপি ঋণ কিছুটা বেড়ে যাবে বলে ধারণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকেও এ বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।

এছাড়া দেশের ব্যাংকগুলোর বিদ্যমান লিগ্যাল টিম অথবা আইন বিভাগকে শক্তিশালী করার কর্মপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে অর্থঋণ আদালতের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে বলে আশা প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাছাড়া অর্থঋণ আদালতের পাশাপাশি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) পদ্ধতিতে আদালতের বাইরে মামলা নিষ্পত্তির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হবে।

ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী নীতিমালা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নীতিমালার ফলে ঋণগ্রহীতাদের ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ পরিশোধ করার প্রবণতা হ্রাস পাবে।

এ বিষয়ে ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের বলেন, খেলাপিদের ধরতে বাংলাদেশ ব্যাংক সব ধরনের পদক্ষেপ নেবে। বিশেষ করে আগে খেলাপিদের চিহ্নিত করা হলেও ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত করা হতো না। এখন থেকে নিয়মিত ঋণ পরিশোধ না করলে তাকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। এসব ঋণখেলাপিরা বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। তারা নতুন করে জমি-বাড়ি-গাড়ি কিনতে পারবেন না। নতুন ব্যবসাও খুলতে পারবেন না তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য কর্মকর্তাদের ভাতা দেয়া হবে। এতে খেলাপি ঋণ আদায়ে গতি ফিরবে। আর ব্যাংকের নিজস্ব মূল্যায়নের পাশাপাশি তালিকাভুক্ত জামানত মূল্যয়নকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণের বিপরীতে ওই জামানত মূল্যায়ন করা হবে। ফলে অতিমূল্যায়িত জামানতের বিপরীতে ঋণ দেয়া বন্ধ করা যাবে। আর সঠিক জামানত থাকলে খেলাপি ঋণের অর্থ আদায় সহজ হবে।

সুশাসন ফেরাতে ছয় কর্মপরিকল্পনা

খেলাপি ঋণ কমানোর পাশাপাশি ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর জন্য ছয়টি কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার পরিচালক নিয়োগে বর্তমান প্রক্রিয়া এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য নীতিমালা হালনাগাদ করা উল্লেখযোগ্য। তাতে ব্যাংকের সামগ্রিক ঋণ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী হবে বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ, তাদের সম্মানী নির্ধারণ এবং দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কিত নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। এতে স্বতন্ত্র পরিচালকরা আমানতকারী ও শেয়ারধারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে সক্ষম হবে। বর্তমানে দু-তিনটি ব্যাংক ছাড়া সব ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালকরা শেয়ারধারী পরিচালকদের অনুগত। ফলে তারা পরিচালনা পর্ষদের স্বার্থই বেশি দেখছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা এমডি নিয়োগ ও পুনর্নিয়োগে বাছাই প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা আরও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। পারদর্শিতার সূচকের ভিত্তিতে এমডিদের কাজের মূল্যায়ন করা হবে। বর্তমানে একাধিক ব্যাংকের এমডিদের শিক্ষাগত সনদ নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে অনেকের অনিয়ম ধরা পড়লেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।

এছাড়া এক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম না করার বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে। কয়েকটি দুর্বল ব্যাংককে সব ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হবে। এ বিষয়ে ডেপুটি গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে চারটি ক্রাইটেরিয়া করে দিয়েছে। এতে ক্রাইটেরিয়া অনুযায়ী দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত হবে। যদি কোনো ব্যাংক ওই ক্রাইটেরিয়ার মধ্যে পড়ে তাহলে ব্যাংকের ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের বার্ষিক প্রতিবেদন ধরে ২০২৫ সালের মার্চে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের আমানত গ্রহণ, ঋণ বিতরণসহ অনেক কার্যক্রম পরিচালনায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হতে পারে।

অন্যদিকে ব্যাংক কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে মৌলিক প্রশিক্ষণ এবং ব্যাংকিং প্রফেশানল পরীক্ষা পাস বাধ্যতামূলক করা হবে।

 

বিষয় ➧

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০