পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট খেলাপি ঋণের অর্থেক। এর মূল কারণ হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধনের পরিমাণ বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় অনেক বেশি। আবার সরকারি ব্যাংকগুলোর বয়সও প্রায় ৭০ থেকে ৮০ বছর। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর তিন থেকে চারটির বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছর। আবার কোনোটি পাঁচ থেকে ছয় বছরের মধ্যে। অর্থাৎ বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেশি থাকা স্বাভাবিক। তবে খেলাপি ঋণের চর্চা থেকে কীভাবে বের হওয়া যায়, সেটির ব্যবস্থা করতে হবে। গতকাল এনটিভির মার্কেট ওয়াচ অনুষ্ঠানে বিষয়টি আলোচিত হয়। হাসিব হাসানের গ্রন্থনা ও সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকি এবং রূপালী ব্যাংক লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আহমেদ আল কবির।
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দেখছি ব্যাংকগুলোতে ঋণখেলাপির চর্চা চলছে। এর ধারাবাহিকতা এখনও বজায় আছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগই ঋণখেলাপি। তবে বেশি ঋণখেলাপি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। সরকার আবার এই ব্যাংকগুলোকে জনগণের করের টাকা দিয়ে আবার গঠন করছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণখেলাপি বা একটি বিশেষ গ্রুপ নিয়ে যাচ্ছে। এটি কেন রোধ করা যাচ্ছে না? প্রতিটি ব্যাংকে নজরদারি বাড়ানো উচিত। যাকে ঋণ দেওয়া হবে তার কাছ থেকে যাতে সহজেই টাকা ফেরত পাওয়া যায়। এমন কাউকে ঋণ দেওয়া যাবে না, যারা টাকা ফেরত দিতে পারবে না। এই জায়গায় প্রতিটি ব্যাংকের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এটি যদি রোধ করা না যায়, ভবিষ্যতে দেশ বিপদের মুখে পড়বে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা দরকার, যাতে ব্যাংকগুলো ভবিষ্যতে অ্যাসেট কোয়ালিটি ধরে রাখতে পারে।
আগের চেয়ে অর্থনীতির আকার অনেক বড় হয়েছে। অনেক বড় বড় মেগা প্রকল্প হচ্ছে। কিন্তু বেসরকারি খাতের তুলনায় সরকারি খাতে বিনিয়োগ অনেক বেড়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগের দিকে তাকালে দেখা যাবে গত সাত থেকে আট বছরে প্রবৃদ্ধির হার ২২ থেকে ২৩ শতাংশেই রয়ে গেছে।
১৯৯৬ সালের পর পুঁজিবাজার সংস্কার হয়েছে। ২০১০ ও ২০১১ সালের পর থেকে অনেক সংস্কার হয়েছে। ২০১০ ও ২০১১ সালের তুলনায় বর্তমানে পুঁজিবাজার অনেক ভালো অবস্থানে আছে, যদিও এর চেয়ে আরও ভালো হওয়ার কথা ছিল। আমরা আশা করি, পুঁজিবাজার সামনে আরও ভালো হবে, কিন্তু এখানে ৯৫ শতাংশ বিনিয়োগ করা হয় ব্যাংক থেকে অর্থ নিয়ে, আর চার থেকে পাঁচ শতাংশ বিনিয়োগ করা হয় পুঁজিবাজারের অর্থায়ন থেকে। সেক্ষেত্রে পুঁজিবাজার সামনে ভালো হবে আশা করা যায় না।
ড. আহমেদ আল কবির বলেন, চলতি বছরের জুনের তথ্য অনুযায়ী মোট ঋণখেলাপি প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট খেলাপি ঋণের অর্ধেক। এর মূল কারণ হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধনের পরিমাণ, আর বেসরকারি সব ব্যাংকের মূলধন সমান নয়। সরকারি ব্যাংকের মূলধনের পরিমাণ বেশি। আবার সরকারি ব্যাংকগুলোর বয়সও প্রায় ৭০ থেকে ৮০ বছর। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর তিন থেকে চারটির বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছর। বাকিগুলো ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, আবার কোনটি পাঁচ থেকে ছয় বছরের মধ্যে। অর্থাৎ বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঋণখেলাপি বেশি থাকা স্বাভাবিক। তবে খেলাপি ঋণের চর্চা থেকে কীভাবে বের হওয়া যায়, সেটির পরিকল্পনা করতে হবে। ৩০ থেকে ৪০ বছর বা পাঁচ থেকে ১০ বছর আগে যেসব ঋণ খেলাপি হয়েছে, কোনোটিই ভালোভাবে সমাধা হচ্ছে না।
আগে ঋণগুলো খতিয়ান বইয়ে লিপিবদ্ধ করা হতো, ফলে সহজে লুকিয়ে রাখা যেত; একমাত্র অফিসারই তা জানত। এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। ব্যাংকগুলোর আধুনিকায়ন হয়েছে। এখন কোনো কিছু লুকিয়ে রাখার সুযোগ নেই। যাদের ঋণখেলাপি পাওয়া যাবে, যারা এর সঙ্গে জড়িত, খেলাপি ঋণ দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করছেÑতাদের বিচার করতে হবে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় এখন অনেক ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। এটি জাতীয় ইস্যু হিসাবে বিবেচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারকে অতি দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি একসময় তিন থেকে পাঁচ শতাংশ ছিল। অর্থনীতি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশেরও বেশি, এডিবির তথ্যমতে, সাত দশমিক পাঁচ শতাংশ, সরকারি তথ্যমতে, সাত দশমিক আট শতাংশ। ২০০৫ সালে রফতানি ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার, এখন রফতানি প্রায় ৩৭ বিলিয়ন ডলার। ঋণখেলাপির জন্য যে বা যারা দায়ী তাদের শাস্তি দিতে হবে। আমাদের বিচার ব্যবস্থাকে ব্যাংক খাতের সহায়ক শক্তি বা অভিভাবক হিসাবে কাজ করতে হবে।
শ্রুতিলিখন: শিপন আহমেদ