খেলাপি ঋণ অবলোপন বাড়ালেও আদায় বাড়েনি

রোহান রাজিব: খেলাপি ঋণ আদায়ে নানারকম সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবু কমছে না ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের অঙ্ক। খেলাপি ঋণ কম দেখাতে ঋণ অবলোপন বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো। গত অর্থবছরে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে দুই হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ অবলোপন বাড়লেও এর আদায় বাড়েনি। এ সময় ব্যাংকগুলো আদায় করেছে এক হাজার ১২৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, খেলাপি ঋণ অবলোপন একটা খারাপ দিক। কারণ যে পরিমাণ ‘রাইট অফ’ করা হয়, সে পরিমাণ আদায় হয় না। ঋণ আদায় না করে যদি ‘রাইট অফ’ কৌশল বেছে নেয়া হয়, তাহলে একসময় ব্যাংকের মূলধনও শেষ হয়ে যায়। তাই একে ভালোভাবে নেয়া যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরের পুরো সময় (জুলাই-জুন) পর্যন্ত ব্যাংকগুলো দুই হাজার ৯৭১ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলো আদায় করেছে এক হাজার ১২৫ কোটি টাকা। গত বছরের জুলাই-সেপ্টম্বর সময়ে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করেছে ৪২৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এ সময় আদায় হয়েছে ১২১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। অক্টোবর-নভেম্বর সময়ে অবলোপন হয়েছে এক হাজার ৪৬৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এ সময় আদায় হয় ৪৪০ কোটি টাকা। এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ৫২৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা অবলোপন করে। ব্যাংকগুলো আদায় করে ২০৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এপ্রিল-জুন সময়ে খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয় ৫৪৪ কোটি ১৩ লাখ টাকার। আদায় হয় ৩৫৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত এক বছরে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। ২০২১ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বেসরকারি ব্যাংক এক হাজার ৮৯৫ কোটি সাত লাখ টাকা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ৯৬৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, বিশেষায়িত ব্যাংক ১১৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ও বিদেশি ব্যাংক ৩৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘অবলোপন করা ঋণ থেকে আদায়ে খুব বেশি অগ্রগতি নেই। ছোটরা কিছু টাকা দিলেও বড়রা টাকা দিচ্ছে না, এটা সত্য। কিন্তু এসব প্রভাবশালীর কাছ থেকে টাকা আদায়ে আইনি কাঠামোতেও বড় ধরনের কোনো সংস্কার হয়নি, আর যা হয়েছে তাও কার্যকর নেই।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ অবলোপনের পুঞ্জীভূত স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৪০২ কোটি ৪২ লাখ টাকায়। এর বিপরীতে একই সময় সুদসহ আদায় হয়েছে ১৭ হাজার ৪১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এটি বাদ দিলে জুন শেষে ব্যাংক খাতে অবলোপন করা ঋণের প্রকৃত স্থিতি দাঁড়ায় ৪৩ হাজার ৩৬০ কোটি ৪৯ লাখ টাকায়। অবলোপন ঋণ হিসাবে নিলে ব্যাংক খাতে জুন শেষে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকায়।

প্রাপ্ত তথ্যে আরও দেখা যায়, চলতি বছরের জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণের পুঞ্জীভূত স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকায়। এই পরিমাণ ঋণ থেকে ব্যাংকগুলো আদায় করতে সক্ষম হয়েছে পাঁচ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। একই সময় শেষে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর অবলোপন করা খেলাপি ঋণের পুঞ্জীভূত স্থিতি দাঁড়ায় ৩৫ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকায়। এ খাতের ব্যাংকগুলো এ পর্যন্ত আদায় করতে সক্ষম হয়েছে ১১ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর অবলোপন করা ঋণের স্থিতি রয়েছে এক হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা এবং বিশেষায়িত খাতের ব্যাংকগুলোর ৬০৬ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকায়। এছাড়া চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার ৮১৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এ সময় আদায় হয়েছে মাত্র চার হাজার ৯৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা।

উল্লেখ্য, ব্যাংকের মন্দ মানের খেলাপি ঋণ দীর্ঘদিন আদায় না হলে তা ব্যাংকের মূল ব্যালান্স শিট থেকে আলাদা করে অন্য একটি লেজারে সংরক্ষণ করা হয়, ব্যাংকিং পরিভাষায় যা ঋণ অবলোপন বা রাইট অফ নামে পরিচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আওতায় ২০০৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করে আসছে। সাধারণত খেলাপি হওয়ার পর মামলা করেও কোনো ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে এলে সে ঋণ অবলোপন করে ব্যাংকগুলো। তবে অবলোপন করা ঋণ পুনঃতফশিল বা পুনর্গঠন করা যায় না।

জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে খেলাপি ঋণ অবলোপনের নীতিমালা শিথিল করা হয়েছে। আগে মামলা ছাড়া ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অবলোপন করা যেত। এখন দুই লাখ টাকা পর্যন্ত মামলা ছাড়াই অবলোপন করা যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন শিথিল নীতিমালার কারণে খেলাপি ঋণ অবলোপন বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০