বেশ কয়েক বছর ধরেই দেশের অর্থনীতির খাতের বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। প্রায়ই অর্থনীতিবিদ-বিশ্লেষকরা ঋণ উদ্ধারে দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। বৃহস্পতিবার বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘আগামী দিনে ব্যাংকিং খাতের জন্য কী পরিণতি অপেক্ষা করছে’ শীর্ষক আলোচনা সভায় অর্থনীতিবিদরা একই অভিমত ব্যক্ত করেন। সভায় আলোচক, ব্যবসায়ী নেতা ও জ্যেষ্ঠ ব্যাংকাররা ব্যাংকিং খাতের বিদ্যমান পরিস্থিতির তীব্র সমালোচনা করেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সোজাসাপ্টা বলেছেন, জনগণের টাকায় ব্যাংক চলে। এটি অনুধাবন না করতে পারলে সমস্যার সমাধান হবে না। মনে রাখতে হবে, যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারাটাই বড় ব্যর্থতা। অন্য বক্তারাও রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক লাইসেন্স বিতরণ, পর্ষদে নিয়োগ ও ঋণ দেয়া, ঋণখেলাপি সংস্কৃতি, বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে শিল্প ও বিনিয়োগে অর্থায়ন পেতে বৈষম্যের কারণে উদ্যোক্তারা ন্যায়বিচার পাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন।
ঋণখেলাপি ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়ায় প্রতি বছর অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বাড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্যে স্পষ্ট হয়, পুরোনো অনাদায়ী ঋণ আদায় তো হচ্ছেই না; নতুনভাবে জোগানো ঋণও খেলাপি হচ্ছে এবং অনাদায়ী ঋণ আদায়ে কর্তৃপক্ষের জোরালো উদ্যোগ নেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব হলো তার অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ ব্যবস্থাপনা নজরদারি করা। এখন অনাদায়ী ঋণ আদায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা জানানো দরকার। খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যর্থ কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দৃষ্টান্ত নেই। এ ধরনের ঋণ আদায়ে অগ্রগতি না হওয়াটা প্রমাণ করে, নিয়মিত পরিদর্শন ও তদারকি করে ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংকের প্রধান কাজ অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ঋণ দেয়া এবং তা আদায়। ব্যাংকের মূল সম্পদই হলো ঋণ। যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সুশাসিত ও শক্তিশালী ব্যাংক খাত অপরিহার্য। আর খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি ভাঙতে জবাবদিহির বিকল্প নেই। খেলাপি ঋণ আদায়ে সদা সক্রিয়ও থাকতে হবে।
সামান্য টাকা চুরির জন্য ছিঁচকে চোর গণপিটুনির শিকার হয় আর বড় ঋণখেলাপিরা উল্টো সামাজিক মর্যাদা ভোগ করছে। এদের নিবৃত্ত করতে ব্যাংক খাতে সুশাসনই যথেষ্ট নয়, সামাজিকভাবেও তাদের বয়কট করতে হবে। বর্তমানে খেলাপি ঋণ থাকলে কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন না। কিন্তু খেলাপি প্রার্থীরা নির্বাচনের আগে যৎসামান্য কিস্তি পরিশোধ করে ঋণ পুনঃতফসিল করিয়ে নেন। নির্বাচনে জিতলে ঋণ নেন নতুন করে। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা (সিআইপি) রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকেন; তেমনি ঋণখেলাপিদের কিছু সুবিধা প্রত্যাহার করা যেতে পারে। আমরা মনে করি, অর্থ লোপাটের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অঙ্গীকার, সদিচ্ছা এবং সব পর্যায়ে প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে বিদ্যমান আইনেই এর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।