Print Date & Time : 23 June 2025 Monday 3:40 am

খেলাপি ঋণ আদায় ও দুর্নীতি

তোফাজ্জল হোসেন: ঋণখেলাপি, কেলেঙ্কারি, জালিয়াতি, হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংকÑএরকম বেশ কিছু শব্দ ও নামের সঙ্গে আমরা কমবেশি অনেকেই পরিচিত। এর কবলে পড়ে দেশের ব্যাংক খাত গত কয়েক বছরে চরম সংকটে রয়েছে। তাতেই তৈরি হয়েছে তারল্যের সংকট। সোজা কথায় ব্যাংকে টাকা নেই, পুঁজি নেই, তাই ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে ঋণ প্রবাহ কমে যাচ্ছে। এসব সংখ্যার হিসাব কতটা ভয়াবহ রকমের গুরুত্বপূর্ণ তা খালি চোখে হঠাৎ করে বোঝা যায় না। কিন্তু এর চরম মূল্য দিতে হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে। বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ খুবই আশঙ্কাজনক। ইতোমধ্যে খেলাপি ঋণে আরেক নয়া মাইলফলক স্পর্শ করেছে বাংলাদেশ। এখন একটু সহজ করে বলা যাক খেলাপি ঋণ আসলে কি যখন কোনো কারণে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পর কোনো ঋণ বা ঋণের কিস্তি ফেরত পাওয়া যায় না বা সম্ভব হয় না; তখন ওই ঋণকে খেলাপি ঋণ বলে গণ্য করা হয়। এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা জর্জরিত এই খেলাপি ঋণ। অনেক পদ্ধতি, কৌশল ও প্রচেষ্টা অবলম্বনের পরও তা আজও হাতের নাগালের বাইরে। অর্থনীতি এখন নানামুখী ঝুঁকিতে রয়েছে। ফলে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। সামাল দেয়া যাচ্ছে না ডলার-সংকট। অর্থের অভাবে ভর্তুকি বাড়াতে পারছে না সরকার। ফলে এক লাফে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণ। সবার এ দুঃসময়ের মধ্যে যাদের সুসময় যাচ্ছে, তাদের মধ্যে অন্যতম ঋণখেলাপিরা।

মাত্র ৬ মাসে ২১ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা ঋণখেলাপি বেড়েছে। এ নিয়ে গত জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। তাদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ২০টি ব্যাংক। খেলাপি বৃদ্ধি পাওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বাকি ১৫টি বেসরকারি খাতের। ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৭৫ শতাংশই আছে এই ২০টি ব্যাংকে। বাকি ৪১টি ব্যাংকে রয়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার সময় উত্তরাধিকারসূত্রে খেলাপি ঋণ পেয়েছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এরপর একের পর এক আর্থিক খাত কেলেঙ্কারি এবং ঋণখেলাপিদের বারবার সুযোগ দেয়ার পর সেই খেলাপি বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে প্রায় সোয়া এক লাখ কোটি টাকা। যদিও খেলাপি ঋণের এ তথ্য ব্যাংকগুলোর দেয়া। তবে সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য অনুযায়ী, এর পরিমাণ তার চেয়েও অনেক বেশি। কেননা খেলাপি ঋণের এ তথ্য ব্যাংকগুলোর নিজেরই দেয়া। এখন যদি বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শন করে দেখতে পারে প্রকৃত চিত্রটা কী  গত ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে একটি প্রতিবেদন অনুযাযী, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ আড়াল করে রাখা আছে। খেলাপি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করা হয়, প্রকৃত খেলাপি ঋণ তার তুলনায় অনেক বেশি। প্রকৃত খেলাপি ঋণ আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি। সেই হিসাব ধরলে এখন প্রকৃত খেলাপি ঋণ আসলে ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এই হিসাব অনুযায়ী প্রকৃত খেলাপি ঋণের টাকা দিয়ে অনায়াসে ১৩টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত। এর মধ্যে অর্থমন্ত্রী খেলাপিদের নানা সুবিধা দিয়েছেন, যার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রাখা গেছে। সুতরাং এখন যে সোয়া লাখ কোটি টাকার তথ্য দেয়া হচ্ছে, সেই হিসাব সম্পূর্ণ অসত্য। সাধারণত তিন মাস পরপর খেলাপি ঋণের তথ্য হিসাব করা হয়ে থাকে। গত মার্চ-জুন সময়ে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার ৮১৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা। আর এ সময়ে সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতের ঋণ বেড়ে হয়েছে ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মন্তব্য, বিশেষ বিবেচনায় যেসব ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে, তা আবার খেলাপি হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি যেসব প্রণোদনা ঋণ বিতরণ হয়েছে, তাও খেলাপি হয়ে পড়ছে। এর ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ছে তো বাড়ছেই। লাগামহীন খেলাপি ঋণের জন্যই অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে এক ধরনের বন্ধ্যত্ব। খেলাপি ঋণের জন্য সাধারণত ব্যাংকে যখন টাকার পরিমাণ কমে যায়, তখন অর্থনীতির ভাষা আমরা সেটাকে তারল্য সংকট বলে থাকি। যখন তারল্য সংকট হয় তখন ব্যাংকের ঋণ দেয়ার ধারণক্ষমতা কমে যায়। তখন যারা বিনিয়োগে যেতে চায় তারা ঋণ পায় না। তাই বিনিয়োগে যেতে পারে না। বিনিয়োগ কমে গেলে অর্থনীতির ওপর নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অর্থনীতির ‘গ্রোথ’ কমে যেতে পারে। চাকরি তৈরির সুযোগসহ কর্মসংস্থানের সুযোগও কমে যায়। এমনকি অবকাঠামোগত উন্নয়নেও পড়ে এর বিরূপ প্রভাব। সামান্য মাত্রায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও পরিবর্তন করতে গেলেও তখন অন্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। অথচ আকাশচুম্বী এই খেলাপি ঋণ যদি না থাকত তাহলে কিন্তু আমরা অনায়াসে বড় বড় প্রকল্প কোনো প্রকার বিদেশি ঋণ বা সাহায্য ছাড়াই সম্পন্ন করা সম্ভব হতো।

আমাদের অর্থনীতিতে অভিশপ্ত খেলাপি ঋণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। কী কারণে সৃষ্টি হয়েছে এই খেলাপি ঋণের; সে সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক। রাজনৈতিক নেতা ও ব্যাংকের পরিচালকদের প্রভাব; রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা; পর্যাপ্ত জামানতের অভাব; খরা-বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ; প্রকল্পের গুরুত্ব ও ভবিষ্যৎ বিবেচনা না করা; পর্যাপ্ত আইনের অভাব; মামলা নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রতা; সরকারের ট্যারিফ নীতিসহ বন্ধকি সম্পত্তির বিক্রয়জনিত জটিলতা ইত্যাদি। এদিকে নতুন গভর্নর এসেই ঋণখেলাপিদের সুবিধা করে দিয়েছেন। তবে সুবিধা দেয়ার নীতি এটাই প্রথম নয়। প্রায় ৪৫ বছর ধরেই সব সরকার নানাভাবে ঋণখেলাপিদের সুবিধা দিয়ে আসছে। ফলে কখনোই দেশে খেলাপি ঋণ কমেনি, বরং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে খেলাপি ঋণ ক্রমে বেড়েছে, ঋণখেলাপিরা আরও বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। নীতি নির্ধারণেও তাদের প্রভাব আছে বলেই বারবার পাচ্ছেন খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার নানা সুবিধা। তাদের বড় অংশ নানা সুবিধা নিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করে রাখতে পারছেন, আবার বেনামে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎও করছেন।

এখন হয়তো প্রশ্ন হতে পারেÑএ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী কীভাবে আমরা এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে পারি এবার সে সম্পর্কে কিছুটা জেনে নিই। নৈতিকতার চর্চা করা; ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক নেতা এবং ব্যাংক পরিচালকদের প্রভাবমুক্ত করা; সরকার ও কেন্দ্রীয ব্যাংককে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে; কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সব ব্যাংককে শুধু খেলাপি ঋণসাপেক্ষে আলাদা করে মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে; যাচাই-বাছাই করে ঋণ প্রদান এবং বিতর্কিত ঋণের যথাযথ পর্যবেক্ষণ; সুশাসন নিশ্চিত করা এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুদক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা; ঋণ প্রদানে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ করা; অর্থ ঋণ আদালতসহ আইনি প্রক্রিয়া আরও উন্নত ও সংস্কার করা; খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের কালো তালিকা প্রকাশ এবং ভবিষ্যতে ঋণ প্রদানে বিরত থাকা; একই খাতে বেশি ঋণ না দিয়ে বিভিন্ন খাতে ঋণ প্রদান করা ইত্যাদি। তাছাড়া অর্থনীতিবিদরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন যে, ব্যাংক খাতে সুশাসনের প্রচণ্ড অভাব আছে এবং এর প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। অর্থনীতির প্রধান খলনায়ক আর্থিক খাতের এ দুর্বলতা। পরিশেষে খেলাপি হওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ ফেরত পাওয়া গেলে ব্যাংক ঋণ আরও বাড়ত, বৃদ্ধি পেত বিনিয়োগ, তৈরি হতো কর্মসংস্থান, বাড়ত মানুষের আয়। পুরো অর্থবছরে সরকার যে ভর্তুকি দেয়, তার চেয়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি। বাংলাদেশে অর্থ ঋণ আদালত আইন ও দেউলিয়া আইনের মধ্যে ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ফাঁকফোকর রয়ে গেছে। ঋণখেলাপিদের জন্য তা টিকে থাকার সুযোগ করে দিচ্ছে। তাই নানাভাবে দেশের ক্ষতি করছেন এই ঋণখেলাপিরা। যেন দুধে ভাতে আছে খেলাপিরা।

শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়