Print Date & Time : 26 June 2025 Thursday 6:04 pm

খেলাপি ঋণ আদায়ই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের প্রধান চ্যালেঞ্জ

নিজস্ব প্রতিবেদক: খেলাপি ঋণ আদায় ও মূলধন ঘাটতি পূরণই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ প্রতিনিয়তই বাড়ছে। ঋণ দিলে তা আদায় করতে পারে না। ঋণগুলো ঢাকা ও চট্টগ্রামের কিছু মুষ্ঠিবদ্ধ মানুষের হাতে চলে যাচ্ছে। এখান থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে বেরিয়ে আসতে হবে।

গতকাল রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে জনতা ব্যাংকের ‘বার্ষিক সম্মেলন ২০১৮’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এছাড়া বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. ইউনুসুর রহমান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত অর্থ সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী প্রমুখ।

সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বড় বিনিয়োগে অর্থায়ন করছে। এটা ব্যাংকিং নিয়ম অনুযায়ী মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। এ অবস্থা এজন্যই যে, আমরা এত দিনেও একটা উপযুক্ত ক্যাপিটাল মার্কেট সৃষ্টি করতে পারিনি। আমরা চেষ্টাও কম করিনি। আমরা দু-দুটো ব্যাংক করেছিলাম এবং আইসিবি করেছি দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য। কিন্তু এখানে আমরা তত সাফল্য অর্জন করতে পারিনি। আমার মনে হয়, ব্যাংকিং সেক্টরে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কী করে আমরা ক্যাপিটাল মার্কেট সৃষ্টি করতে পারি। তবে এজন্য আমরা একটি গ্রুপকে ব্যাংক দেব, যাতে তারা এটা সৃষ্টি করতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, মূলধন ঘাটতি পূরণ ও খেলাপি ঋণ আদায়ই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ সময় জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে গভর্নর বলেন, আপনাদের বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা মোকাবিলা করতে হবে। বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার আগ্রহ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। খাত, এলাকাভিত্তিক এবং করপোরেট বডিভিত্তিক কোনো ঋণ দেওয়া যাবে না। এসএমই ও রিটেইলে জোর দিতে হবে। খেলাপি ও অনাদায়ী ঋণ আদায়ে জোর দিতে হবে। এছাড়া মামলাগুলোও নিষ্পত্তি করতে হবে। লোকসানি শাখা কমিয়ে আনতে হবে। অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ব্যবস্থায় জোর দিতে হবে। এছাড়া ব্যাংকগুলোতে জবাবদিহিতার বিষয়টির ওপর জোর দেন তিনি। জনতা ব্যাংক শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছ থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি বলেও জানান তিনি।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. ইউনুসুর রহমান বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বেশকিছু দুর্বল দিক রয়েছে। এই ব্যাংকগুলো নিয়ে নানা ধরনের সমালোচনা রয়েছে। এ খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ প্রতিনিয়তই বাড়ছে। ঋণ দিলে তা আদায় করতে পারে না তারা। ঋণগুলো ঢাকা এবং চট্টগ্রামের কিছু মুষ্ঠিবদ্ধ মানুষের হাতে চলে যাচ্ছে। এখান থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে বেরিয়ে আসতে হবে।

ইউনুসুর রহমান বলেন, গ্রাহকসেবা নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর নানা ধরনের সমালোচনা রয়েছে। এসব ব্যাংকের কর্মকর্তারা সরকারি চাকরিজীবীর মনোভাব নিয়ে বসে থাকে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বুঝতে হবে সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যাংক কর্মকর্তার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রধান কাজই হচ্ছে জনগণকে সেবা দেওয়া। তাদের সরকারি কর্মকর্তার মনোভাব নিয়ে বসে থাকলে চলবে না।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে বিচারহীনতার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অন্যতম দুর্বল দিক হলো এখানে ভালো কাজের পুরস্কার ও খারাপ কাজের শাস্তির বিষয়টি আমরা নিয়মিত করতে পারিনি। ঋণ অনিয়মে দায়ী কর্মকর্তাদের শাস্তি দিতে হবে এবং ভালো কাজের পুরস্কার দিতে হবে। এ সময় গ্রামগঞ্জের শাখাগুলোকে উন্নয়নের পরামর্শ দেন তিনি।

গ্রাহকসেবার বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকারি চাকরি শুধু হুকুমের জন্যই নয়, মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্যও। সেবার মনোভাব নিয়েই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাজ করতে হবে। খেলাপি ঋণের বিষয়ে তিনি বলেন, খেলাপি ঋণের বোঝাটা অনেক বড় হলেও এটা আগের তুলনায় বড় নয়। একসময় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৪০ শতাংশ, যা এখন ১০ শতাংশ।

অর্থমন্ত্রী বলেন, চলতি বছর নির্বাচনী বছর হলেও অর্থনীতি অস্থিতিশীল হবে না। প্রবৃদ্ধির হারও ভালো এ বছর। চলতি বছরে হঠাৎ করেই ঋণের সুদহার অনেক বাড়তে শুরু করে। এ বিষয়ে দু-এক দিন আগে আমি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বসেছিলাম। ব্যাংকগুলোতে কোনো তারল্য সংকট নেই। কিছু সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এসব ব্যাংকে সরকারি আমানত বাড়লেই এই সংকট কেটে যাবে। আগে বাধ্যতামূলকভাবে সরকারি আমানতের ৭৫ শতাংশ রাখা হতো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে। আর ২৫ শতাংশ পেত বেসরকারি ব্যাংক। বেসরকারি ব্যাংকের মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এটিকে এখন ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে যে সংকট তৈরি হয়েছে, সেটি কেটে যাবে এবং শিগগিরই তারা ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে পারবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত অর্থ সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে এখন এসএমই বিনিয়োগে যেতে হবে। সরকারি খাতের ব্যাংকগুলো জনগণকে যেসব সেবা দিয়ে থাকে, তা ধীরে ধীরে টেকনোলজির কাছে চলে যাচ্ছে। তাই এ খাতের ব্যাংকগুলোকে অন্যান্য ব্যবসার দিকে নজর দিতে হবে।

সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান লুনা সামসুদ্দোহা। এছাড়া স্বাগত বক্তব্য রাখেন ব্যাংকটির সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুস ছালাম আজাদ।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের তথ্যানুযায়ী, জনতা ব্যাংকে মোট আমানত রয়েছে ৬৪ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা। এছাড়া ঋণ ও অগ্রিমের পরিমাণ ৪৫ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা। মোট সম্পদ ৮০ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা এক হাজার ১৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। মোট শ্রেণীকৃত ঋণ পাঁচ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। ব্যাংকটির মোট ৯১২টি শাখা রয়েছে।