Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 5:37 pm

খেলাপি ঋণ ও মূলধন সংকটে ডুবছে গচিহাটা অ্যাকুয়াকালচার

বিনিয়োগকারীদের কাছে ওভার দ্য কাউন্টার বা ওটিসি মার্কেট মানেই পদে পদে ভোগান্তি। এতে একসময় কোম্পানির খোঁজ-খবর নেওয়া বন্ধ করেন বিনিয়োগকারীরা। পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরাও কোম্পানিগুলোর খোঁজ রাখেন না। যে কারণে সবার অগোচরে কোম্পানিগুলোতে চলে নানা অনিয়ম। তেমনই কিছু কোম্পানি পরিদর্শনকালে পাওয়া তথ্য নিয়ে শেয়ার বিজের ধারাবাহিক আয়োজন। আজ ছাপা হচ্ছে চতুর্থ পর্ব

পলাশ শরিফ: আশির দশকের শেষদিকে পথচলা শুরু গচিহাটা অ্যাকুয়াকালচার ফার্ম লিমিটেডের। তখনও আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ ও গরু পালন বা কৃষিভিত্তিক শিল্প ততটা জনপ্রিয় ছিল না। চ্যালেঞ্জিং হলেও শুরুটা ভালোই ছিল। কিন্তু ব্যবসায় পূর্বঅভিজ্ঞতা না থাকা ও অনিয়মের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে নেওয়া খেলাপি ঋণের কারণে বিপাকে পড়েছেন কোম্পানিটির উদ্যোক্তা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান। ‘ঋণখেলাপি’ তকমার কারণে মূলধন সংকটে ডুবছে গচিহাটা অ্যাকুয়াকালচার।

ঋণখেলাপির তকমা আর পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে দু’দশক ধরে ধুঁকছে গচিহাটা অ্যাকুয়াকালচার। উৎপাদন বন্ধ, কাগুজে শেয়ার ও টানা লোকসানের কারণে বর্তমানে ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেটে অবস্থান করছে তারা। ওটিসি থেকে মূল মার্কেটে ফেরার কোনো লক্ষণ এখনও দৃশ্যমান নয় কোম্পানিটির।

তথ্যমতে, ১৯৮৮ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদীতে গচিহাটা অ্যাকুয়াকালচারের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়। খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানিটির মাধ্যমে কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা গড়ে তোলা হয়েছিল। এরপর পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয়ে ১৯৯৮ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানিটি। এর পরিশোধিত মূলধন ২০ কোটি টাকা।

এ প্রকল্পে অগ্রণী ব্যাংকের ঢাকাস্থ বিএএফ শাখার মাধ্যমে ১৯৯৪ সালে প্রায় আট কোটি ২০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়। ব্যবসায়িক মন্দার কারণে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয় কোম্পানিটি। এরপর ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সময়ে তিনটি সিসি (হাইপো) ঋণের মাধ্যমে আরও প্রায় ৯ কোটি ৫২ লাখ টাকা দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। তারপরও অবস্থার উন্নতি হয়নি। ২০০৪ সালে গচিহাটা অ্যাকুয়াকালচারকে ‘রুগ্ণ শিল্প’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের কাছে কোম্পানিটির দায় ৬৫ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বর্তমানে  কোম্পানিটির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। ২০১৯ সালের জুনে শেষ হওয়া আর্থিক বছরেও প্রায় ৩৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা লোকসান দেখিয়েছে কোম্পানিটি।

গচিহাটা অ্যাকুয়াকালচারের উদ্যোক্তা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘গচিহাটা অ্যাকুয়াকালচার কোনো ভুঁইফোঁড় কোম্পানি নয়। ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করার জন্য এ কোম্পানির জš§ হয়নি। এর মালিক এখনও জনগণ। মূলত কৃষিভিত্তিক শিল্পায়নের পথ তৈরির জন্যই এ ব্যবসায় নেমেছিলাম। কিন্তু ব্যবসায়িক মন্দার কারণে পিছিয়ে পড়েছে কোম্পানিটি। এরপর রাজনৈতিক কারণেই জটিলতা তৈরি হয়েছে। কারণ, আমার গায়ে একটি দলের লেবেল আছে। আমার সম্পদ আছে; কিন্তু পুঁজির অভাবে কিছু করতে পারছি না। রাষ্ট্র তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের অসহযোগিতার কারণেই এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। মূলধন জোগানো নিয়ে ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে।’

এদিকে ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হওয়া কোম্পানিটিকে ঋণ প্রদান ও সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর। এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুরোনো ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থতার পরও নতুন করে সিসি ঋণ দেওয়া, খেলাপি হওয়ার পরও পারফরম্যান্স গ্যারান্টি ও বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি করে পাওনা আদায় না করা এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অমান্য করে বারবার সুদ মওকুফ করায় ২০১৩ সাল পর্যন্ত সময়ে অগ্রণী ব্যাংকের প্রায় ৩৪ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। সে সঙ্গে গচিহাটা অ্যাকুয়াকালচারের বকেয়া আদায়কে ‘অনিশ্চিত’ বলে উল্লেখ করে সুদ মওকুফ আদেশ বাতিল ও আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছে অডিট অধিদপ্তর।

আলাপকালে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘গচিহাটা অ্যাকুয়াকালচারের যখন শুরু, সে সময়ে কৃষিভিত্তিক শিল্প-কারখানা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। এখনকার মতো বাজার ও ব্যবসায়িক পরিবেশ ছিল না। তারা বিদেশ থেকে গরু এনে খামার করেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে কোম্পানিটি ব্যবসায় পিছিয়ে পড়ে। বকেয়া ঋণ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিছুদিন আগেও কোম্পানির উদ্যোক্তা একটি চিঠি দিয়েছেন। ঋণ টেক-ওভার নিয়ে অন্য ব্যাংকের সঙ্গেও কথা হচ্ছে। পুরোনো জটিলতা নিরসনে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’   

উল্লেখ্য, ২০০০ সালের পর থেকে লোকসানের মুখে থাকা কোম্পানিটির বাণিজ্যিক উৎপাদন ২০০৪ সালে বন্ধ হয়ে গেছে। লোকসানের কারণে ২০০৯ সালের ১ অক্টোবর কোম্পানিটিকে তালিকাচ্যুত করেছে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ। একই কারণে ২০১০ সালে ওটিসি মার্কেটে পাঠিয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। কোম্পানিটির ২০ লাখ ৭০ হাজার ‘কাগুজে’ শেয়ারের মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছেই সবচেয়ে বেশি (প্রায় ৫৬ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ) শেয়ার রয়েছে। এর বাইরে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের কাছে প্রায় ২৫ দশমিক ৮৬ লাখ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে প্রায় ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। সর্বশেষ গত ২ জানুয়ারি কোম্পানিটির ১০০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ার ওটিসিতে ৩৩ টাকা ৫০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে।