খেলাপি ঋণ বেড়ে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা

রোহান রাজিব: নানা সুবিধা দেয়ার পরও বেড়েছে খেলাপি ঋণ। ২০২২ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকায়, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে খেলাপির অঙ্ক ছিল ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৬ হাজার ৫২ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ২০২২ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের অঙ্ক ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। তিন মাস পর জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ কোটি ২৫৭ টাকা। সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ১১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা, যা শতাংশ হিসাবে ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণ বাড়বেই। যতদিন না সরকার ঋণ ফেরাতে আন্তরিক হবে ততদিন দেশে খেলাপি কমবে না। এ দেশে ইচ্ছাকৃত খেলাপির সংখ্যা বেশি। তাই বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেয়ার পরও কোনোভাবেই খেলাপি ঋণ কমানো যায়নি। নতুন করে আবার ব্যবসায়ীদের যে সুযোগ দিয়েছে এত খেলাপি ঋণ দিন দিন আরও বেড়ে যাবে। এতে ব্যাংক খাতের ভালো গ্রাহকরাও খেলাপির দিকে দাবিত হবে। তাই এখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত হবে এ বিষয়ে কঠোর হওয়া।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা; যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। যেখানে তিন মাস আগে ব্যাংক খাতে ঋণ ছিল ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা; যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, খেলাপি ঋণ এমনি ব্যাংক খাতের সমস্যা। এর সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে ছাড় দেয়া। এ ছাড়ের কারণে অনেকে ভাবছেন, না দিলে চলবে। তাই দিন দিন খেলাপি ঋণ লাগামহীন বাড়ছে। খেলাপি বাড়ার কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, যারা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত তাদের দেখে এ সুযোগ দেয়া যেতে পারে। তবে এভাবে ঢালাওভাবে ছাড় দেয়া ব্যাংক খাতের জন্য খুবই খারাপ চর্চা। এ খারাপ চর্চার ফলে ভালো গ্রাহকরাও দেখা যাবে খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুন শেষে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে ২ লাখ ৫২ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫৫ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে, যা মোট ঋণের ২১ দশমিক ৯৩ শতাংশ। তিন মাস আগে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ ছিল ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪৮ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে, যা মোট ঋণের ২০ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।

বেসরকারি ব্যাংকগুলো ২০২২ সালের জুন শেষে মোট ঋণ বিতরণ করেছে ১০ লাখ ৪২ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬২ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে, যা মোট ঋণের ৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। গত মার্চে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৯ লাখ ৮৮ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৫৭ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

জুন শেষে বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা; যা এই অঙ্ক ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে মোট ৩৫ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা। গত মার্চ শেষে বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ১৫ কোটি টাকা। ঋণ বিতরণ ছিল মোট ৩৩ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা। আর বিদেশি ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ৬৭ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকের দুই হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৪০ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

উল্লেখ্য, কভিডের দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে আবারও সংক্রমণ বাড়ছে। দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সৃষ্ট বন্যায় এরই মধ্যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বহির্বিশ্বে সাম্প্রতিক যুদ্ধাবস্থার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালসহ বিভিন্ন উপকরণের মূল্য ও পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। এসব কারণে ঋণগ্রহীতাদের নেয়া ঋণের বিপরীতে কিস্তির পুরো অর্থ পরিশোধে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে এসেছে। এসব দিকবিবেচনায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা বজায় রাখা ও বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের গতিধারা স্বাভাবিক রাখতে উদ্যোক্তাদের ঋণ পরিশোধে গত ২৪ জুন ছাড় দিয়ে সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সুবিধা দেয়া হয়।

এর আগে করোনা মহামারির দেখা দেয়ার পর ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সব ধরনের ঋণ পরিশোধে ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২১ সালে ওই ছাড় তুলে নেয়া হলেও ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে কিস্তির ১৫ শতাংশ পরিশোধের শর্তে খেলাপি মুক্ত থাকার সুযোগ পান ব্যবসায়ীরা। চলতি বছরে বিশ্বমন্দার কথা বলে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে নতুন করে আবার ছাড় দিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০