শেখ মোহাম্মদ রতন, মুন্সীগঞ্জ: মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের নয়ানগর এলাকায় মেঘনা নদীতে বর্ষার শুরুতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে বিলীন হয়েছে বেশ কয়েকটি বসতভিটা। এছাড়াও ভাঙন ঝুঁকিতে পড়েছে ওই এলাকার একটি ৩০০ বছরের পুরোনো মসজিদসহ অন্তত সাড়ে চার শতাধিক ঘরবাড়ি। গ্রাম ও ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি রক্ষায় দ্রæত স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি স্থানীয়দের।
গত বুধবার সকালে নয়ানগর এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, মেঘনা নদীর পাড়ের নয়ানগর শাহী জামে মসজিদের নিচ থেকে মাটি সরে কলাম বেরিয়ে এসেছে।
মাটি সরে যাওয়ায় মসজিদ রক্ষা বাঁধের বøকসহ দেয়াল ধসে পড়েছে। বর্ষায় পানি বাড়লে, ভাঙন অব্যাহত থাকতে পারে। এতে যে কোনো সময় মসজিদটি নদীতে বিলীন হতে পারে। মসজিদ ধরে উত্তর দিকে এগোতেই দেখা যায়, কয়েকটি বসতবাড়ি সুরক্ষা দেয়াল ভেঙে পড়ে আছে। বাড়িঘরের নিচের মাটি সরে কয়েকটি এক পাশে হেলে আছে।
এ সময় ওই এলাকার ভাঙনের শিকার এবং স্থানীয় অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, ৮ থেকেত ১০ বছর আগেও নয়ানগর মসজিদ থেকে ৪০০ মিটার পশ্চিমে ছিল মেঘনা নদী। নদী ও মসজিদের মধ্যখানে মানুষের ঘর-বাড়ি, ফসলি জমি ছিল। গত কয়েক বছর ধরে মেঘনা নদীর নীরব ভাঙন চলছে। ভাঙনে মসজিদ থেকে উত্তরদিকে নয়ানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকার বসতভিটা, জমিজমা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। গত বর্ষায় ভাঙতে ভাঙতে সেটি মসজিদের কাছাকাছি এসে ঠেকেছিল। কয়েকদিন আগে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। সে সময় ঢেউ ও স্রোতের কারণে আকসি¥ক ভাঙন শুরু হয়। এতে নদী পাড়ের তারা মিয়া, জাহাঙ্গীর মাস্টার, রফিকুল ইসলামদের বসতভিটা বিলীন হয়ে যায়।
বাড়ির তলদেশের মাটি সরে যাওয়ায় পেয়ারা বেগম, আওয়াল গাজী, আজিলারীদের ঘর ভেঙে পড়েছে। ভেঙে গেছে বসতবাড়ির সুরাক্ষা দেয়াল। ভাঙন ঝুঁকিতে পড়েছে এই এলাকার ৩০০ বছর পুরোনো নয়ানগর শাহী জামে মসজিটিও।
স্থানীয়রা বলেন, দুই দিন নদীতে বেশি পানি ছিল, তাতেই এত ক্ষতি। এবার বর্ষার আগে ভাঙন ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপ না নেয়া হয়, তাহলে পানি বাড়ার সঙ্গে নয়ানগর গ্রামের মসজিদসহ সাড়ে চার শতাধিক বসতভিটা নদীতে বিলীন হতে পারে।
ভাঙনের শিকার হতদরিদ্র তারা মিয়া প্রধান (৭৫) নয়ানগরের প্রয়াত আয়াত আলী প্রধানের ছেলে। বংশ পরম্পরায় এ এলাকায় বসবাস তার। তারা মিয়ার স্ত্রী, শারীরিক প্রতিবন্ধী এক ছেলে ও বিধবা এক মেয়ে, মেয়ের ঘরে এক নাতিকে নিয়ে তার সংসার। দুটি ছোট ভাঙাঘরে থাকতেন তারা। মানুষের সাহায্য সহযোগিতায় কোনো রকমে চলে তাদের সংসার। গত ২৮ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালের সময় নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। সে সময় স্রোত ও ঢেউয়ের কারণে একটি ঘর নদীতে বিলীন হয়ে যায়।
তারা মিয়া বলেন, ‘বাপ-দাদার জমিজমা চোখের সামনে ভাঙতে ভাঙতে শেষ হইলো। শেষ সম্বল ভিটা-মাটিডা আছিলো। এইডাও ভাইঙ্গা যাইতাছে। একটা ঘর শেষ। সরকার ব্যবস্থা না নিলে অন্যডাও ভাইঙ্গা যাইবো। ঠিকমত খাওন জোডে না। নতুন কইরা ঘর করা, জায়গা কিনা, কোনডার কোনডারই সামর্থ নাই।’
ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত জাহাঙ্গীর মাস্টার বলেন, ‘৩০০ বছরের পুরোনো আমাদের গ্রামটি। একটু একটু করে মেঘনা ঘিলে খাচ্ছে। একের পর এক আমরা ঘরবাড়ি হারা হচ্ছি। কেউ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।’
এর আগেও মেঘনার ভাঙনে ভিটেমাটি হারান মো. আলী কাজী ও মো. আরাফাতরা।
এদিন কথা হয় এ দু’জনের সঙ্গে। তারা জানান, আমাদের সামর্থ্য ছিল আমরা অন্যত্রে বাড়ি করে আছি। আমাদের গ্রামের অধিকাংশ মানুষ গরিব। দিন আনে দিন খায়। একবার কেউ ভাঙনের শিকার হলে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও হারাবে। তাই বাসিন্দাদের বসতভিটা, ঐতিহ্যবাহী মসজিদ, একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং গ্রামটি রক্ষা করতে হলে জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন আটকাতে হবে। মসজিদ থেকে উত্তর দিকে নয়ানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় স্থায়ীভাবে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে।
ইউনিয়নটির এক নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মো. মামুন জানালেন একই কথা। তিনি বলেন, এলাকার ক্ষয়ক্ষতির ছবি তুলে ইউনিয়ন কার্যালয়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে।এ গ্রামটি বাঁচাতে হলে বেড়িবাঁধের বিকল্প নেই।
ওই এলাকাটি পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হয়েছে বলে জানান গজারিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কোহিনুর আক্তার।
তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে ছয়জন ক্ষতিগ্রস্তের নাম পেয়েছি। তাদের ঢেউ টিন ও খাদ্য সহায়তা দেয়া হবে। ওই এলাকার ভাঙন ঠেকাতে স্থায়ী একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানানো হয়েছে।
ওই এলাকার ভাঙনের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে এবং তাৎক্ষণিকভাবে ভাঙন ঠেকাতে সেখানে জিওব্যাগ ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান মুন্সীগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহিদুল ইসলাম। এই কর্মকর্তা বলেন, স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা তাদের কাজ শুরু করেছে। কমিটির তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো পাঠানো হবে। বরাদ্দ পেলে সেখানে কাজ শুরু করা হবে।