Print Date & Time : 25 June 2025 Wednesday 5:04 pm

গঠিত হলো ইসলাম গ্রুপ

ঢাকার পতিত নগর পরিসরে সহসা রাজধানী জেগে ওঠায় আবাসন ও নির্মাণ খাত হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। সেই বাতাবরণে জহুরুল ইসলামের সৃজনী পদক্ষেপ ছিল তুরুপের তাস। ক্ষুদ্র ঠিকাদারি দিয়ে শুরু। দেশের সীমানা মাড়িয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে তিনি গড়েছেন আকাশচুম্বী অট্টালিকা, সড়ক-মহাসড়ক, কল-কারখানা; এমনকি দেশের আঙিনায় বুলন্দ করেছেন বিদেশি বড়-প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক ও শৌখিন গাড়ির সমৃদ্ধি। রাজধানী ঢাকার নির্মাণ, আবাসন ও বিস্তৃতির বিবর্তনিক ইতিহাসের ধারাক্রমে জহুরুল ইসলাম তাই এক অবিচ্ছেদ্য প্রাসঙ্গিকতা। পর্ব-৩৫

মিজানুর রহমান শেলী: আবাসন ব্যবসার পাশাপাশি ঠিকাদারি নির্মাণকাজে বিডিসির কার্যক্রম নিয়ত ধারায় এগিয়ে চলছিল। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নির্মাণকাজ পেয়ে গেলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ বিল্ডিং। এ কাজটিও তিনি সফলভাবে শেষ করলেন।
জহুরুল ইসলাম ছিলেন খুব সতর্ক, বিচক্ষণ ও নিষ্ঠাবান। তিনি ছোট-বড় সব ধরনের ঠিকাদারি কাজ করতেই পছন্দ করতেন। তার শুরু হয়েছিল ক্ষুদ্রা ঠিকাদারি কাজের ভেতর দিয়ে। তবে এর মাঝেই তিনি বিশাল বড় কাজ করার বিশাল সাহসও অর্জন করে নিয়েছিলেন।
তিনি ব্যবসায় কাজে ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ১৯৬৩-৬৪ সালে আইয়ুব আমলে পাকিস্তান সরকার সংসদ ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু নির্মাণকাল নির্ধারণ হলো খুব সংক্ষিপ্ত। এ কাজটি পেলেন জহুরুল ইসলাম। সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে এই বিশাল কাজটি করার ঝুঁকি নেওয়ার মাঝেই বোঝা যায় তিনি তার কাজের প্রতি কতটা সাহসী ও কর্তব্যনিষ্ঠ ছিলেন। যাই হোক কাজ শুরু করলেন এবং ৪০ দিনের মধ্যে কাজ শেষ হলো। এটা পুরোনো বিমানবন্দরের কাছে তেজগাঁওয়ের মধ্যে। এরপর তিনি দোতলা এমপি হোস্টেলে ৬০টি কক্ষ নির্মাণ করেন। এটা করেছিলেন ৩৫ দিনে। এ দুটো প্রকল্প ছিল ওই সময়ের নির্মাণকাজের একটি অনন্য নৈপুণ্য।
ষাট থেকে সত্তরের মাঝে দেশের শিল্প ও সংস্কৃতিতে বাঙালি জাতীয়তাবোধের ধারা প্রভাবিত হতে থাকে। স্থাপত্যও সেই পথ খুঁজতে থাকে। ফলে আন্তর্জাতিক রীতিতে তৈরি ইমারতের মধ্যেও ইটের তৈরি একটি বাঙালি শৈলীর উšে§ষ ঘটতে থাকে। সম্ভবত এ প্রক্রিয়ার প্রথম পরিচয় মেলে চারুকলা ইনস্টিটিউটের ভবন নির্মাণে। এমনকি এই ধারা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল শেরেবাংলা নগরের এই জাতীয় সংসদ ভবনের নকশায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাঠাগার ও চারুকলা মহাবিদ্যালয়ের নকশায় সমসাময়িক পাশ্চাত্য স্থাপত্যের ধ্যান-ধারণাকে সমন্বিতভাবে ধারণ করা হয়েছিল। এটা ছিল আধুনিক স্থাপত্যের গুরু লি কর্বুজিয়েরের একটি ব্যক্তিগত প্রয়াস। এসব বৈশিষ্ট্যগুলোর মাঝে ছিল কিউবিক ফর্ম, উš§ুক্ত নিচতলা, খোলা খাম, অ-ভারবাহী বিভাজক দেয়াল, কংক্রিট কাঠামো, সমতল ছাদ, র‌্যাম্প ও লুভর। প্রকল্পের বিভিন্ন ভবনে ছিল পারস্পরিক সমন্বয়, হালকা কাঠামো, কাঠামো ও নির্মাণগত স্বচ্ছতা, চাকচিক্যহীন স্বাভাবিক সৌন্দর্য। এগুলোর সঙ্গে ছিল সমন্বিত নিসর্গ। এ দুটো প্রকল্পই হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্যের প্রথম নিদর্শন। এ প্রকল্পে আমিনুল ইসলামের দেয়ালচিত্র ও নভেরা গওহরের ভাস্কর্য ব্যবহার হয়েছিল। ফলে প্রথমবারের মতো স্থপত্যে চারু ও কারুশিল্পের বহুমুখী সংযোজন ঘটল। এমনকি বহুমুখী শিল্পশৈলীর সুপ্ত সম্ভাবনা এখানে উšে§াচিত হলো।
জাতীয় সংসদ ভবন প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার পেছনে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রভাব বিস্তার করেছিল। রাজনৈতিক কারণেই কেন্দ্রীয় সরকার এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এলাকাটিকে দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে পরিকল্পনা করা হয়। এ কারণে সংসদ ভবন নির্মাণকাজেও জহুরুল ইসলামকে খুব কম সময়ই দেওয়া হয়েছিল। এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে জহুরুল ইসলাম সফল হয়েছিলেন। তাছাড়া পূর্ব পাকিস্তানবাসীর জাতীয়তাবাদী মনোভাবকে শান্ত করার জন্য লি কর্বুজিয়র বা আলভার আলতোর মতো গুরু স্থপতিদের কাজে লাগানোর চেষ্টা করে সরকার। যদিও শেষাবধি মার্কিন স্থপতি ও শিক্ষক লুই কান এ দায়িত্ব সম্পন্ন করেন। সংসদ ভবন আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও সমালোচিত স্থাপত্য নির্দশন।
এটি বাংলাদেশের পরবর্তী স্থাপত্যিক ধারা ও তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ভালো উদাহরণ। কঠিন শৃঙ্খলাবদ্ধ আধুনিক রীতির ধারক এটি। এখানে ভবনের মাঝে পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রচেষ্টা মূর্ত হয়ে উঠেছে।
যাই হোক এই ১৯৬৪ সালটি ছিল জহুরুল ইসলামের জন্য বর্ণালি আর সমৃদ্ধ একটি বছর। তিনি এ সময় কয়েকটি কাজ সম্পন্ন করেন। এগুলোর মধ্যে টয়োটা সেলস, হিনো কমার্শিয়াল ভেহিকল সেলস, আফটার সেলস ডিপার্টমেন্ট (সার্ভিস) ও আফটার সেলস ডিপার্টমেন্ট (স্পেয়ার পার্টস) প্রতিষ্ঠা।
১৯৬৪ সালের ২০ এপ্রিল টয়োটা সেলসের যাত্রা শুরু হয় জহুরুল ইসলামের হাত ধরে। এটাই ছিল টয়োটা মোটর করপোরেশনের সঙ্গে জহুরুলের প্রথম অংশীদারি ব্যবসায় অভিযাত্রা। এ সময়ে ইউরোপ ও আমেরিকাই মূলত পূর্ব পাকিস্তানের যানবাহন বাজার দখল করেছিল। এগুলোর মধ্যে ছিল ভক্স ওয়াগন, জেনারেল মোটরস ও ফোর্ড ইত্যাদি। টয়োটা করোনার মাধ্যমে ১৯৬৪ সালে এদেশের বাজারে ইউরোপ-আমেরিকার কদর কমতে শুরু করে। এমনকি ধীরে ধীরে তাদের শেয়ারও কমতে থাকে। এভাবেই এখানকার বাজারে জাপানি গাড়ির যুগ শুরু হয়েছিল। ইউরোপ আর আমেরিকার বাজার ক্রমান্বয়ে বসে পড়ায় জাপানি বাজার টয়োটার মাধ্যমে সর্বোচ্চ স্থান দখল করল। বহুজাতিক ও সরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও কূটনৈতিক মিশন ও সমাজের উচ্চ পর্যায়ের মানুষরা এই প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা রেখে চলেছে।
নাভানা হলো নাভানা গ্রুপের নামকোম্পানি। ১৯৬৪ সালের মার্চে এটি প্রতিষ্ঠা করেন জহুরুল ইসলাম। এটি হিনো মোটরের একমাত্র ডিলারশিপ পেয়েছিল। সালটা তখন ১৯৮২। হিনো মোটরের মান আর নাভানার পরিচিতি দেশে ক্রেতাদের কাছ প্রথম পছন্দের তালিকায় চলে আসে। শফিউল ইসলাম কামাল এখন এর চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আছেন। এটি এখন জাপানি বাণিজ্যিক যানের মধ্যে ‘এক নম্বরে’ অবস্থান করছে।
ষাটের দশকের শেষ সময়ে, নাভানা গ্রুপ জাপানের হিনো মোটরের একচেটিয়া পরিবেশকে পরিণত হয়। এমনকি কমার্শিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন সেক্টরে একটি বিশাল অঙ্কের মার্কেট শেয়ার অর্জনেও সক্ষম হয়। বর্তমানে হিনো আভিজাত্যের প্রতীক এবং ট্রান্সপোর্ট খাতে হিনো গাড়ির রয়েছে নিরাপত্তা ও বিশ্বস্ততা।
ইাভানা ও টয়োটা সেই শুরু থেকেই একটি বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরপর জহুরুল ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন আফটার সেলস ডিপার্টমেন্ট (সার্ভিস)। পণ্য বিক্রি পরবর্তী সেবা দানের এই প্রতিষ্ঠানটি তার কাজের মান, নির্ভরযোগ্যতা, বিশ্বস্ততায় পরিণত হয়েছে। সারা দেশে এরাই একমাত্র এই টয়োটা গাড়ি বিক্রি ও তার সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এই বিক্রি-পরবর্তী সেবাদান প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে একটি দক্ষ কারিগরি দল। তারা গ্রাহকের সঙ্গে আন্তরিক এবং বিশ্বস্ততা অর্জনে প্রতিশ্রুতিশীল। এখানে সবাই ভালো সুবিধা পেয়ে থাকে বলেও একটি পরিচিতি রয়েছে। এরা নিজেরাই টয়োটা জেনুইন স্পেয়ার পার্টস বিক্রি করে থাকে বাংলাদেশে। পণ্যের মান ও আন্তরিক সেবা দিতে তারা প্রতিশ্রুতিশীল।
টয়োটার জেনুইন স্পেয়ার পার্টসের একমাত্র স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান নাভানা। আফটার সেলস ডিপার্টমেন্টে (স্পেয়ার পার্টস) এর কার্যক্রম চলে। জহুরুল ইসলাম এই প্রতিষ্ঠানটাও ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন।
উল্লেখ্য, নাভানা লিমিটেড প্রতিষ্ঠার আগে জহুরুল ইসলাম জাপানের টয়োটা কোম্পানির সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে টয়োটা গাড়ি বাজারজাতকরণের একটি চুক্তি করেন। যাকে বলে ডিস্ট্রিবিউটরশিপ। ১৯৬৪ সালে নাভানা লিমিটেড প্রতিষ্ঠার পরেই ব্যবসায় সমূহ সমৃদ্ধি সাধিত হতে থাকে। কিছুদিনের মধ্যেই প্রতিষ্ঠা হয় ইসলাম গ্রুপ। তখন থেকেই নাভানা এ ইসলাম গ্রুপের আওতাধীন। গ্রুপটির চেয়ারম্যান হন আলহাজ জহুরুল ইসলাম।
এদিকে বিডিসি নির্মাণকাজ চলছিল বহাল তবিয়তে। ১৯৬৫ সালে বিডিসি বুয়েটের হোস্টেল কমপ্লেক্স বিল্ডিং করে। এরপরের বছরেই ১৯৬৬ সালে ইসলাম চেম্বারের ১৫ তলা হেড কোয়ার্টার বিল্ডিং নির্মাণ করে। উল্লেখ্য, এই বিল্ডিংই হলো বাংলাদেশের প্রথম বহুতল বিল্ডিং।
ঔপনিবেশিক আমলে অর্থাৎ ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পরের কথা। সে সময় পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশের গভর্নরের সরকারি বাসভবন হিসেবে ঢাকায় জমকালো দ্বিতল ভবনের নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। এটি রমনা গ্রিনের প্রান্তঘেঁষে সুদৃশ্য কার্জন হলের বিপরীতে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউয়ে অবস্থিত। যাহোক পরিকল্পনা অনুযায়ী এটির নির্মাণকাজ শেষ হলো। কিন্তু তৎকালীন ভারত সরকারের নিযুক্ত স্থপতি মনে করলেন, স্থাপনাটি গভর্নর হাউজ হিসেবে বেমানান। তাই তা খালি পড়ে থাকে। পরে এই ভবন ঢাকা উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ ব্যবহার করতে থাকে। আরও পরে ভবনটি আর কলেজের আওতায় থাকে না। এটিকে পূর্ব পাকিস্তানের হাইকোর্টে রূপান্তর করা হয়। সেই থেকেই এখানে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের যাত্রা শুরু হলো। কিন্তু পরিকল্পনা সুপ্রিমকোর্টের পরিকল্পনায় তা নির্মিত না হওয়ায় স্বভাবতই স্থাপনাটি চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম ছিল না। তাই এর পাশেই আরেকটি ভবন নির্মাণ করা হলো। বর্তমানে এটাকে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট ভবন বলা হয়।
এই নবনির্মিত সুপ্রিমকোর্ট ভবনটি নির্মাণের দায়িত্ব পায় জহুরুল ইসলামের বিডিসি কোম্পানি। তখন ১৯৬৭ সাল। বিডিসি এ কাজ সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করে ১৯৬৮ সালে।
সুপ্রিমকোর্ট ভবন নির্মাণকাজ শেষ করেই জহুরুল ইসলাম হাত দেন বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন নির্মাণকাজে। তখন এমন যেন নির্মাণকাজে বিডিসির একক অধিকার। কাজের ক্ষেত্রে জহুরুলের সততা, সাহসিকতা আর দক্ষতা এই পর্যায়ে নিতে সহায়ক হয়েছিল। ১৯৬৮ সালেই তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন নির্মাণকাজ শেষ করেন।
লেখক: গবেষক, শেয়ার বিজ