রহমত রহমান: গণকর্মচারীদের করবর্ষের মধ্যেই আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে। সঙ্গে দিতে হবে সম্পদ বিবরণী। ফলে তাদের এক পাতার রিটার্ন জমা দেয়ার সুযোগ নেই। আবার গণকর্মচারী যে গ্রেডের হোক, বেতন যা-ই হোক, তাদের রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নতুন আয়কর আইন অনুযায়ী, রিটার্ন দাখিল না করলে গণকর্মচারীদের বেকায়দায় পড়তে হবে। বন্ধ হবে বেতন-ভাতাসহ সুবিধা। নিতে পারবেন না ৪৩ ধরনের সুবিধা। শুধু তা-ই নয়, বেতন-ভাতা ছাড়ের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিকে বেতন-ভাতা ছাড়ের সময় রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র যাচাই করতে হবে। না হলে বেতন-ভাতা ছাড়ের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিকে জরিমানার মুখোমুখি হতে হবে। নতুন আইন অনুযায়ী গণকর্মচারীদের রিটার্ন দাখিল নিশ্চিত করতে কর অঞ্চলগুলো সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিচ্ছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণকর্মচারীদের রিটার্ন ও সম্পদ বিবরণী দাখিল নিশ্চিত করতে পারলে সুবিধা হবে। কোনো কর্মচারী অপরাধ, দুর্নীতি করলে তার সম্পদ আর খুঁজতে হবে না। রিটার্নের সঙ্গে সম্পদ বিবরণী তদন্ত করলে ব্যবস্থা নিতে পারবে। সরকার এরই মধ্যে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি। নতুন আইন অনুযায়ী ‘গণকর্মচারীদের’ রিটার্ন ও সম্পদ বিবরণী দাখিল নিশ্চিত করতে এনবিআরের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে, গণকর্মচারী শৃঙ্খলা (নিয়মিত উপস্থিতি) অধ্যাদেশ, ১৯৮২ অনুযায়ী গণকর্মচারী বলতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত অথবা যেকোনো বিধিবদ্ধ সংস্থায় চাকরিরত ব্যক্তিকে বোঝায়। এনবিআর বলছে, গণকর্মচারী বলতে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বোঝানো হয়েছে।
সম্প্রতি বরিশাল কর অঞ্চল থেকে ‘গণকর্মচারীদের’ রিটার্ন দাখিল নিশ্চিত করতে ওই কর অঞ্চলের কর্মকর্তাদের চিঠি দেয়া হয়, যাতে গণকর্মচারীদের রিটার্ন দাখিল বিষয়ে আয়কর আইন-২০২৩-এর বিভিন্ন ধারা তুলে ধরা হয়। চিঠিতে বলা হয়েছে, আয়কর আইনের ১৬৬ (গ) ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি গণকর্মচারী হলে তিনি রিটার্ন দাখিল করবেন। এই ধারায় বলা হয়েছে, ওই ব্যক্তি একটি কোম্পানি, কোনো শেয়ারহোল্ডার পরিচালক বা কোনো কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার কর্মচারী, কোনো ফার্ম, কোনো ফার্মের অংশীদার, কোনো ব্যক্তিসংঘ, কোনো ব্যবসায় নির্বাহী বা কোনো ব্যবস্থাপকের পদধারী কোনো কর্মচারী, কোনো গণকর্মচারী হন বা কোনো অনিবাসী, যার বাংলাদেশে স্থায়ী স্থাপনা রয়েছে।
আরও বলা হয়েছে, আয়কর আইনের ধারা ১৬৭ (১) অনুযায়ী সব গণকর্মচারী আবশ্যিকভাবে পরিসম্পদ ও দায়ের বিবরণী দাখিল করবেন। পরিসম্পদ ও দায়ের বিবরণী দাখিল করার এই ধারায় বলা হয়েছে, এই ধারার অন্যান্য বিধানাবলি সাপেক্ষে প্রত্যেক স্বাভাবিক করদাতা আবশ্যিকভাবে পরিসম্পদ ও দায়ের বিবরণী দাখিল করবেন। যদি সেই ব্যক্তির আয়বর্ষের শেষ তারিখে ৪০ লাখ টাকার অধিক মোট সম্পত্তির মালিক হন বা আয়বর্ষের যেকোনো সময় কোনো মোটরযানের মালিক হন বা সিটি করপোরেশন এলাকার মধ্যে সংশ্লিষ্ট আয়বর্ষে গৃহ সম্পত্তি বা অ্যাপার্টমেন্টে বিনিয়োগ করেন বা আয়বর্ষের কোনো সময়ে বিদেশে কোনো পরিসম্পদের মালিক হন বা কোনো কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার পরিচালক হন। তবে শর্ত থাকে যে, এই উপ-ধারার শর্তাবলি পালন সাপেক্ষে সব গণকর্মচারী আবশ্যিকভাবে পরিসম্পদ ও দায়ের বিবরণী দাখিল করবেন।
চিঠিতে বলা হয়েছে, আয়কর আইনের ২৬৪(৩) ২৭ ধারা অনুযায়ী, গণকর্মচারীর বেতন ভাতাদি প্রাপ্তিতে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ বা পিএসআর দাখিল করতে হবে। আইনের ২৬৪ ধারায় ‘রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দাখিলের বাধ্যবাধকতার’ বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। ধারা ২৬৪(৩)-তে ৪৩টি সেবা ও কাজের ক্ষেত্রে পিএসআর জমা দিতে হবে। এর মধ্যে ২৭ নম্বরে রয়েছে ‘গণকর্মচারীর বেতন-ভাতাদি প্রাপ্তি’। অর্থাৎ সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নেয়ার ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ বা পিএসআর জমা দিতে হবে।
অন্যদিকে আয়কর আইনে পরিবর্তন আনায় ৩০ নভেম্বর কর দিবসের পর রিটার্ন জমা দিলে করদাতাদের জরিমানা ও বাড়তি কর দিতে হবে। আইনের ২৬৬(১) ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক করদাতাকে কর দিবসের মধ্যে রিটার্ন জমা দিতে হবে। না হলে মাসিক চার শতাংশ হারে বিলম্ব সুদ দিতে হবে। পাশাপাশি সর্বশেষ প্রদেয় করের ওপর ১০ শতাংশ বা এক হাজার টাকার মধ্যে যেটি বেশি সেই অঙ্কের জরিমানা হবে। এছাড়া কর নির্ধারণ প্রক্রিয়ায়ও পরিবর্তন আসবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, করদাতাকে মোট আয়ের ওপর কর পরিশোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে করদাতা আয়কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত হবেন না এবং কর রেয়াতও পাবেন না।
এ বিষয়ে এনবিআরের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, পুরোনো আয়কর আইনে সরকারি কর্মচারী (গর্ভমেন্ট এমপ্লয়), যাদের বেতন ১৬ হাজার টাকা তাদের রিটার্ন বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু নতুন আইনে গণকর্মচারী হিসেবে পাবলিক ও গভর্নমেন্ট সার্ভেন্ট উভয়কেই সম্পদ বিবরণীসহ রিটার্ন দিতে হবে। গণকর্মচারীর বেতন মুখ্য নয়। ফলে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী থেকে সচিব পর্যন্ত সবাইকে সম্পদ বিবরণীসহ রিটার্ন দিতে হবে। রিটার্ন না দিলে গণকর্মচারী ধারা ২৬৪(৩) ধারা অনুযায়ী ৪৩টি সেবা নিতে পারবেন না। এছাড়া ধারা ২৬৬(১) অনুযায়ী রিটার্ন দাখিলের ব্যর্থতায় শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। আর গণকর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ সুবিধা ছাড়ের সময় ছাড়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র যাচাই করতে হবে। অন্যথায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ২৬৪(৭) ধারা অনুযায়ী অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হবে।
এছাড়া সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র যাচাই না করলে সুবিধা দানে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে শাস্তির মুখে পড়তে হবে। আইনের ২৬৪(৭) ধারা অনুযায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। সেজন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বিষয়টি জানিয়ে কর অঞ্চল থেকে চিঠি দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি সিলেট কর অঞ্চলের আওতাধীন সার্কেল-১৩ (মৌলভীবাজার) থেকে ওই জেলা পর্যায়ের সব দপ্তর প্রধানকে চিঠি দেয়া হয়েছে। উপকর কমিশনার এনামুল হাছান আল নোমান সই করা চিঠিতে বলা হয়, নতুন আয়কর আইনের বিধান অনুযায়ী রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দাখিলের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। চিঠিতে আইনের ২৬৪(৫,৬,৭) ধারা তুলে ধরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়।
আইনের ২৬৪(৫) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যেই সকল ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দাখিল বাধ্যতামূলক, সেই সকল ক্ষেত্রে কোনো নমিনেশন, মনোনয়ন বা আবেদন যাচাই-বাচাই, কোনো লাইসেন্স অনুমোদন, সার্টিফিকেট, সদস্যপদ, অনুমতি, ভর্তি, এজেন্সি বা ডিস্ট্রিবিউটরশিপের অনুমোদন, ঋণ অনুমোদন, ক্রেডিট কার্ড ইস্যু, সংযোগ বা অপারেশন অনুমোদন, নিবন্ধন সম্পাদন বা পেমেন্টের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দাখিল ব্যতীত কোনো প্রকার যাচাই-বাচাই, অনুমোদন, অনুমতি, মঞ্জুর, ইস্যু, ছাড়, সম্পাদন বা পেমেন্ট প্রদান হতে বিরত থাকবেন।’ ২৬৪(৬) ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তির নিকট রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দাখিল করা হবে, সেই ব্যক্তি বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত পদ্ধতিতে দাখিলকৃত রিটার্ন দাখিলের প্রমাণাদির সঠিকতা যাচাই করবেন। আর ২৬৪(৭) ধারায় বলা হয়েছে, যেসব ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দাখিল বাধ্যতামূলক, সেসব ক্ষেত্রে এসব অর্থ প্রদান বা সেবা দেয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দাখিল নিশ্চিত করবেন। দাখিলকৃত রিটার্ন দাখিলের প্রমাণাদির সত্যতা যাচাইয়ে ব্যর্থ হলে সেই দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি উপকর কমিশনার অনধিক ১০ লাখ টাকার অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।