গণতন্ত্র ও ভারতের নির্বাচন

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন: বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও শ্রেষ্ঠ গণতান্ত্রিক দেশ ভারত। গত ৪ জুন ভারতের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করে দেশটির নির্বাচন কমিশন। ভারতের নির্বাচন বেশ কয়েকটি দফায় অনুষ্ঠিত হয়, অর্থাৎ বিভিন্ন তারিখে বিভিন্ন আসনের ভোট গ্রহণ করে নির্বাচন কমিশন। তবে ভোট কাউন্টিং অর্থাৎ গণনা হয় এক দিনে, ৪ জুন। পৃথিবীর কোনো দেশে এভাবে ভোট গ্রহণ করে এক দিনে ফল প্রকাশের নজির খুবই কম। এভাবে ভোট গ্রহণ করে রেখে দিয়ে একসঙ্গে ভোট গণনা করার পরও ভারতে কোনো কারচুপির অভিযোগ ওঠে না। তাই ভারতকে বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্ট গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা হয়। এবারের নির্বাচনে ভারতের কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তবে জোটগতভাবে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট (ন্যাশনাল ডেক্রেটিক অ্যালায়েন্স) পেয়েছে ২৯২টি আসন। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট পেয়েছে ২৩৪টি আসন, বাকি আসনগুলো পায় অন্যান্য দল। তবে ভারতের নির্বাচনে কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি, এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে। ভারতীয় সংসদের ৫৪৩ আসন বিশিষ্ট নিম্নকক্ষটির এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি পেয়েছে ২৪০টি আসন। কংগ্রেস ৯৯টি, সমাজবাদী পার্টি ৩৭টি, তৃণমুল কংগ্রেস ২৯টি, ডিএমকে ২২টি, টিডিপি ১৬টি, জেডইউ ১২টি, শিবসেনা (উদ্ভব) ৯টি, ন্যাশনালিষ্ট কংগ্রেস পার্টি আটটি, শিবসেনা (এসএইচএম) সাতটি আসন, পাঁচটি আসন পেয়েছে লোক জনশক্তি পার্টি, চারটি করে আসন পেয়েছে সিপিআইএম, ওয়াইএস আরসিপি ও রাষ্ট্রীয় জনতা দল। আর আম আদমী পার্টি, ঝাড়খণ্ড মোর্চা ও ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ পেয়েছে তিনটি করে আসন। মহা দাপুটে বিজেপি ২০১৯ নির্বাচনে শরিক বাদে এককভাবে আসন পেয়েছিল ৩০৩টি। এই নির্বাচনে ৬৩টি আসন কম পেয়েছে মোদির বিজেপি। মৌলবাদ নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে, বিজেপির চেয়ে বেশি হিন্দুত্ব মৌলবাদী সংগঠন শিবসেনা। এবার এই সংগঠনটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়। একটি নাম শিবসেনা উদ্ভব, অপরটি শিবসেনা (এসএইচএম)। উপমহাদেশের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক সংগঠন ভারতীয় কংগ্রেস। ২০২৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল বেশ ভালো করেছে দলটি। কংগ্রেস দলটি ২০১৪ সালে পেয়েছিল ৪৪টি, ২০১৯ সালে পায় ৫২টি, আর এবারের ২০২৪ সালে এসে দলটির একক আসন দাঁড়ায় ৯৯টিতে। এর ফলে প্রমাণিত হয় ধর্মান্ধতা থেকে ভারতীয় রাজনীতির উত্তরণ ঘটছে। অপরদিকে বিজেপির ১৯৮৪ সালে আসন ছিল দুটি, ১৯৮৯ সালে ৮৫ আসন, ১৯৯১ সালে ১২০ আসন এবং ১৯৯৬ সালে পায় ১৬১ আসন। ক্রমান্বয়ে বিজেপির অগ্রগতি হতে থাকে। ২০১৪ সালে হিন্দু মৌলবাদকে কাজে লাগিয়ে মোদির দৌড়ের রথ লাগামহীনভাবে এগুতে শুরু করে। নরেন্দ্র দামোদর মোদি বিজেপির মূল নেতায় পরিণত হন ২০১৪ সালে। আর তখনই হিন্দু মৌলবাদের বাতাবরণে ২০১৪ সালে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হয়। তারপর ২০১৯ সালে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সংসদীয় আসনের অধিকারী হয়ে যায়। তবে ভারতীয় রাজনীতি মৌলবাদ কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে বা কতটা সময় টিকে থাকতে পারবে, এই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। ভারত মূলত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ভারতীয় রাষ্ট্রটি ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভ করে বহু ভাষা, বহু ধর্ম ও নানা বর্ণের মানুষের সমন্বয়ে। রাষ্ট্র তার কাঠমোতে ধর্মের প্রলেপ লাগাতে দেয়নি কখনও। মোদি তার দুবারের সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করার সময় ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছিল, কিন্তু নানা চাপে তা পারেনি। এবারের নির্বাচনে ভারতীয় জনগণ প্রমান করল যে, তারা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চায়। বিজেপির ২০২৪ সালের নির্বাচনী জোটের অন্যতম মিত্র অন্ধ্র প্রদেশের তেলেগু দেশম পার্টির চন্দ্রবাবু নাইডু ও বিহারের জেডইউ’র নীতিশ কুমার। নরেন্দ্র মোদির এবারের সরকার গঠন করতে এই দুই নেতাকে পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কারণ ভারতীয় গণতন্ত্রে সরকার গঠনের বিষয়ে মতামত দেয়ার অধিকার রয়েছে নির্বাচিত প্রত্যেক সংসদ সদস্যের। তাই জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করলেই জোটের বড় দলকে সমর্থন দিতে হবে, এমন কোনো বিধিবিধান নেই। অর্থাৎ ভারতীয় সংসদীয় পদ্ধতিতে রাজনৈতিক নেতারা দলদাসে পরিণত হন না। তাই দেখা যায়, দলীয় প্রধানকে সবার মতামতে গুরুত্ব দিয়ে দল পরিচালনা করতে হয়। ভারতীয় সংসদে সিপিএম থেকে নির্বাচিত স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় সিপিএম আনীত বিলের বিপক্ষে ভোট দেন। অর্থাৎ ভারতীয় রাজনীতিতে রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করা রাজনীতিকদের নৈতিক দায়িত্ব। তাই রাষ্ট্রের কথা ভেবে তারা সংসদে বিভিন্ন বিলে সমর্থন দেন। ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশÑএ কথাটা ভারতীয় গণতন্ত্রে প্রমাণিত হয়। তাই ভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। ভারতের ৩৫টি প্রদেশের মধ্যে পশ্চিম বাংলা একটি রাজনীতি-সচেতন রাজ্য। পশ্চিম বাংলার রাজনীতিতে ধর্মীয় মৌলবাদ আঁচড় ফেলতে পারেনি এখন পর্যন্ত। ২০১৯ সালের নির্বাচনে ১৮টি আসন পায় বিজেপি, তখন সবাই ভেবেছিল বাংলাও গেরুয়াদের দখলে চলে যাবে। তবে ২০২৪ সালে এসে তা কমে দাঁড়ায় ১২টিতে। একটি বিষয় লক্ষ করলে দেখা যায়, এবারের নির্বাচনে উত্তর বঙ্গের আটটি আসনের মধ্যে বেশি আসন পায় বিজেপি। বিজেপি পায় ছয়টি আসন। এই আসনগুলো হলো আলিপুর দুয়ার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, রায়গঞ্জ, বালুরঘাট, মালদা উত্তর; অপরদিকে কোচবিহার তৃণমূল ও দক্ষিণ মালদা পায় কংগ্রেস। উত্তর বঙ্গে বাঙালি জনগোষ্ঠীর চেয়ে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি। এটাও বিজেপির বিজয়ের একটি অন্যতম কারণ। অপরদিকে বাংলার বাকি ৩৪টির মধ্যে ছয়টিতে জয়ী হয় বিজেপি। বাঙালিরা ধর্মভীরু, কিন্তু উগ্রবাদী নয়, এটা এই নির্বাচনে আবারও প্রমাণিত হলো। মোদি প্রতিবার নির্বাচনের সময় ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা চালান। এবারেও তার ব্যতিক্রম করেননি। তিনি ২০১৪ সালের নির্বাচনের ধ্যানে বসে ছিলেন, ২০১৯ সালেও তাই করেন, ২০২৪ সালেও তিনি কঠোর ধ্যানে মগ্ন হন। মোদিজির এই ধ্যান কর্মকাণ্ডটি ইউটিউব, টিভি চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করা হয়। ভাইরাল করার মূল কারণ হলো বিজেপির পক্ষে জনসমর্থন টানা। তবে এবারের নির্বাচনে তিনি এই কৌশলটা কাজে লাগাতে পারেননি। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় দেশ হলো ভারত। একটি কথা আছে, ‘যা নাই ভূ-ভারতে, তা নাই এই জগতে।’ সুতরাং এ কথাটি ভারতীয় জনগণ ধরে রাখতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। তাই ভারতীয় জনগণ অসাম্প্রদায়িকতার বাতাবরণে এর ব্যত্যয় ঘটাতে চায় না, তারা রাখতে চায় ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে। ভারতের অনগ্রসর রাজ্যগুলোয় মৌলবাদী রাজনীতি এবারের নির্বাচনে ভালো করেছে। ভারতের বৃহৎ রাজ্য উত্তর প্রদেশে এবারের নির্বাচনে মোদির ভরাডুবি ঘটেছে। উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় রাম মন্দির স্থাপন করে তিনি এই প্রদেশের মানুষের সমথর্নটা নিজের পক্ষে আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। উত্তর প্রদেশে এনডিএ জোট পেয়েছে ৩৮টি আসন। ৮০টি আসনের মধ্যে বাকি ৪২টি আসন পায় আইএনডিএ জোট। ভারত এবারের নির্বাচনে ৯৭ কোটি ভোটারের মধ্যে মোট প্রদান করে প্রায় ৬৮ কোটি ভোটার, ভোট প্রদানের হার প্রায় ৭০ শতাংশ, যা মার্কিন নির্বাচনগুলোর চেয়ে প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেশি। গণতান্ত্রিকভাবে প্রায় ৭০ শতাংশ ভোট পড়াটাও একটি বিশাল ব্যাপার। ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গণতন্ত্র অনুশীলনের একটি ক্ষেত্র তৈরি করতে পেরেছে, এই কথাটি নিঃসন্দেহে বলা যায়। গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য রাজনৈতিক দলগুলো হলো একটি রাজনৈতিক পাঠশালা। রাজনৈতিক দলগুলোই মানুষকে গণতন্ত্র অনুশীলন করাবে।

তাই ভারতের কাছ থেকে বিশ্বের সব দেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থার শিক্ষা নেয়া উচিত।

উন্নয়ন কর্মী ও মুক্ত লেখক

দরিখোরবোনা, রাজশাহী

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০