মাসুম বিল্লাহ: ২০২১ থেকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত ২০ বছর মেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে খসড়া প্রণয়ন করেছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। চারটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে এ পরিকল্পনা। আর এটির হাত ধরেই উন্নত দেশের তালিকায় নাম লেখানোর স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। উন্নত রাষ্ট্রে উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাবে সুশাসন, গণতন্ত্রায়ণ, বিকেন্দ্রীকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি।
জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে পরিকল্পনার খসড়া উপস্থাপন করেন জিইডির সদস্য (জ্যেষ্ঠ সচিব) ড. শামসুল আলম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ও ড. মসিউর রহমান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার অনোয়ারুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি-বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সাজ্জাদুল হাসান ও প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম।
খসড়া উপস্থাপনায় জানানো হয়, মূলত রূপকল্প ২০২১-এর সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ‘রূপকল্প ২০৪১’ গ্রহণ করা হয়েছে। এর লক্ষ্য ২০৩১ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য অবসান, উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশের মর্যাদা উত্তরণ ও ২০৪১ সালে উচ্চ-আয়ের দেশের মর্যাদায় আসীন হওয়া। এতে আরও উল্লেখ করা হয়, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা-২০৪১-এর মূল উপাদানগুলো পরবর্তী অর্ধশতাব্দীতে বাংলাদেশকে এমন এক ত্বরান্বিত গতির পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে, যা হবে দ্রুত ও রূপান্তরধর্মী। ফলে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা, পরিবহন ও যোগাযোগসহ সব ক্ষেত্রে দ্রুত রূপান্তর ঘটবে। এ রূপান্তরের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হবে। সবার জন্য, বিশেষ করে দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রবৃদ্ধির সুফল যথাযথভাবে বণ্টনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত প্রবৃদ্ধির সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে। ব্যাপকভাবে এসব লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার প্রচেষ্টার পাশাপাশি সরকারকে এটিও নিশ্চিত করতে হবে যে, মূল প্রাকৃতিক সম্পদ, যেমন ভূমি, পানি, বন, প্রাকৃতিক আবাস ও বায়ুর ব্যবহার যেন এমনভাবে করা হয়, যাতে সেগুলোর নির্বিচার ধ্বংসসাধন ও অবক্ষয় এড়ানো যায়।
এ পরিকল্পনায় ২০৪১ সালে উন্নত দেশ গড়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কাজেই সে সময় নাগাদ দেশে মাথাপিছু আয় হতে হবে সাড়ে ১২ হাজার ডলার। এটিই এ পরিকল্পনার প্রধান অভীষ্ট বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। আর দ্বিতীয় অভীষ্ট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে দারিদ্র্য নির্মূল করার পাশাপাশি পরিবেশের সুরক্ষা, উদ্ভাবনী জ্ঞান, অর্থনীতির বিকাশ ও উৎপাদিকা শক্তি বাড়ানোর উপযোগী অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা।
পরিকল্পনার ভিত্তিবছর ধরা হয়েছে ২০২০ সালকে। এ সময়ে প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে আট দশমিক দুই শতাংশ, যা চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটের মাধ্যমে অর্জিত হবে। আর ২০৩০ সাল নাগাদ গড় প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৯ শতাংশ। ২০৪১ সালে গড় প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। একই সঙ্গে চরম দারিদ্র্য বা হতদারিদ্র্য ২০৩০ সালের মধ্যেই শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে পরিকল্পনায়। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টগুলোরও (এসডিজি) একই লক্ষ্য রয়েছে। মূলত সে বিষয়টি এ পরিকল্পনায় প্রতিফলিত হয়েছে। বর্তমানে হতদরিদ্র মানুষের হার ৯ শতাংশের মতো। আর বর্তমানে উচ্চ দারিদ্র্য প্রায় ২১ শতাংশ। ২০৩০ সাল নাগাদ এটি ৯ দশমিক ৯ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ পাঁচ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
খসড়ায় আরও উল্লেখ করা হয়, অর্থনৈতিক অংশীদারেরা প্রয়োজনীয় প্রণোদনা পান। বিশেষ করে তারাই প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদে বিনিয়োগকে প্রভাবিত করে, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি লালন করে, উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনকে প্রবর্ধিত করে। রূপকল্প ২০৪১ ও সংশ্লিষ্ট প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১ চারটি প্রাতিষ্ঠানিক স্তম্ভের ওপর নির্ভরশীল, যার সুফলভোগী হবে জনগণ এবং তারাই হবে প্রবৃদ্ধি ও রূপান্তর প্রক্রিয়ার প্রধান চালিকাশক্তি। স্তম্ভগুলো হলো সুশাসন, গণতন্ত্রায়ণ, বিকেন্দ্রীকরণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি। বস্তুত এই চারটি ভিত্তির ওপর স্থাপিত হবে উন্নত জাতি হিসেবে সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশের অদম্য অগ্রযাত্রা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. শামসুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১’ বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বপ্নদলিল। বর্তমানে আমরা প্রথম স্বপ্নদলিল ২০১০ থেকে ২০২১ সাল মেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছি। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সাফল্যের ওপর ভর করেই দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে পরিসংখ্যান ব্যুরোর উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি জানান, উন্নত দেশের স্বপ্ন পূরণ ও টেকসই প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে সরকার বেশকিছু পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এসব পরিকল্পনা দলিল তৈরিতে প্রধান ভূমিকা পালন করছে জিইডি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর জিইডি ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এরপর একে একে প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, শতবছর মেয়াদি ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০, জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র, এসডিজি অর্জনের রূপরেখা প্রণয়নসহ সরকারের মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে চলেছে জিইডি। বর্তমানে দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ছাড়াও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলছে। এসব পরিকল্পনার খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার পর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে (এনইসি) অনুমোদনের পর সেগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় কৃষির আধুনিকায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আধুনিক কৃষি হবে বহুমুখী এবং দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ুসহিষ্ণু। আগামী দুই দশকের মধ্যে উচ্চ আয়ের মর্যাদায় আসীন হওযার জন্য ভবিষ্যতের উদ্ভাবনমুখী জ্ঞান অর্থনীতির সমর্থনে শিক্ষায় গুণগত মানোন্নয়ন এবং দক্ষতা উন্নয়নে মানবপুঁজি বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই।