গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা ছাড়া এসডিজি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়

নিজস্ব প্রতিবেদক: উন্নয়নের মধ্যে ন্যায্যতা আনতে হবে। উন্নয়নে যদি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর হিস্যা নিশ্চিত না হয়, তাহলে সেই উন্নয়ন প্রকৃত উন্নয়ন হয় না। আর গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা ছাড়া পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। কারণ গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতাই এ পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর কণ্ঠস্বর সামনে তুলে আনার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। আর গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে নির্বাচন। এজন্য এসডিজির মূলমন্ত্র ‘কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না’Ñবাস্তবায়নের জন্য গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে গতকাল এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও ন্যায্যতার লক্ষ্যে নাগরিক এজেন্ডা: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সামাজিক সুরক্ষা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য শাহীন আনামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। এসডিজির ১৭টি অভীষ্টকে তিনটি স্তম্ভে ভাগ করে মোট ১১টি বিষয়ভিত্তিক সুপারিশমালা প্রস্তুত করেছে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম। সেই ১১টি বিষয়ের মধ্যে সামাজিক খাতের চারটি বিষয়ে প্রণীত সুপারিশমালা গতকাল তুলে ধরা হয়।

অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিগত বছরগুলোয় পিছিয়ে পড়া মানুষ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ভোগের ক্ষেত্রে অগ্রগামী হতে পারেনি। উন্নয়নে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বিগত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা ও পরিসংখ্যানে এটা প্রকাশ্য সত্য যে, বাংলাদেশে বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈষম্য শুধু সম্পদ কিংবা অর্থের নয়, ভোগেও বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সবাই সমান ভোগ করতে পারেনি। তাই উন্নয়নের ন্যায্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে।

তিনি বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে পরিস্থিতির আনুকূল্যের ঘাটতি থাকায় সে সময় নাগরিক সমাজ এ ধরনের সুপারিশ দেয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহবোধ করেনি। কিন্তু এবার নির্বাচনের প্রাক্কালে গত দেড় দশকের উন্নয়নের অভিজ্ঞতা আমরা মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছি। এটা করতে গিয়ে আমাদের মনে হয়েছে, জাতীয় উন্নয়নের যে আখ্যান বা বয়ান আমরা সর্বদা শুনি, সেটা কতখানি সত্য ও মজবুত তা বোঝা প্রয়োজন। এটি বুঝতে গিয়ে আমরা বাংলাদেশের সাতটি জায়গায় বিপন্ন ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫০০ মানুষের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তিনি বলেন, বিগত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা ও পরিসংখ্যানে এটা প্রকাশ্য সত্য যে, বাংলাদেশে বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈষম্য সম্পদ কিংবা অর্থের নয়, এখানে ভোগেও বৈষম্য বেড়েছে। পিছিয়ে পড়া মানুষ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ভোগের ক্ষেত্রে অগ্রগামী হতে পারেনি।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমানে দেশে এক দেশ দুই সমাজ ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে। এক্ষেত্রে একটি সমাজ অনেক বেশি এগিয়ে, অন্যটি অনেক বেশি পিছিয়ে রয়েছে। আর যারা এগিয়ে গেছে, তারা কীভাবে এগিয়েছে, সেটি না বলাই ভালো।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশে দৃশ্যমান উন্নয়ন হচ্ছে। আমরা এগিয়েছি সন্দেহ নেই। কিন্তু যে মানুষগুলো বিপন্ন অবস্থায় আছে, তাদের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছাতে পারিনি। উন্নয়নের মধ্যে ন্যায্যতা আনতে হবে। পিছিয়ে পড়া মানুষের হিস্যাকে সামনে আনতে হবে। উন্নয়নের ন্যায্যতা ফিরিয়ে আনাই হলো আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ। গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতাই পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোকে জায়গা দেয়। সবচেয়ে বড় ক্রিয়াক্ষেত্র হলো নির্বাচন। নির্বাচনের অঙ্গীকার সামনে নিয়ে আসতে হবে। পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নয়নকে বারবার উপস্থাপন করতে হবে।

অনুষ্ঠানে শিক্ষা খাতের বিষয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, কভিডকালে ৫৬৫ দিন স্কুল বন্ধ ছিল। এ সময়ে বিপুল মাত্রায় শিখন ক্ষতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু সেই শিখন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব জানিয়ে তিনি বলেন, কেবল অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়ালে চলবে না। শিক্ষার প্রকৃত সুফল পেতে হলে শিক্ষার্থীদের ওপর বিনিয়োগের বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। এছাড়া তিনি বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের জন্য তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির ওপর জোর দেন।

স্বাস্থ্য খাতের বিষয়ে প্রতিবেদন তুলে ধরতে গিয়ে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের উপদেষ্টা ড. ইয়াসমিন এইচ আহমেদ বলেন, স্বাস্থ্যসেবায় রোগীর আউট অব পকেট কস্ট বা রোগীর নিজস্ব ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। এ ব্যয় কমিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় দালালের উপস্থিতি আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে যে ব্যয় হয়, তার একটি বড় অংশ বিভিন্ন মধ্যবর্তী কমিশনভোগীদের পকেটে চলে যায়। এক্ষেত্রে নাগরিকদের জন্য স্বাস্থ্য বিমা প্রচলন ও বাজারে যেসব ওষুধের সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দেয়, সেগুলোর সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সরকারি ওষুধ সরবরাহ ব্যবস্থা জোরদার করা এবং ওষুধশিল্পের কাঁচামাল সহজলভ্য করতে দেশে প্রতিষ্ঠিত এপিআই শিল্প পার্ককে কার্যকর করার ওপর জোর দেন তিনি।

পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. এম আবু ইউসুফ। এ সময় তিনি সরকারের ১১৩টি সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের একটি ডেটাবেজ তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বিশেষ করে সামাজিক সুরক্ষা খাতের অর্থ যাতে অপচয় না হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রকৃত সুবিধাভোগীদেরও একটি ডেটাবেজ তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট স্থানীয় ঝুঁকি মোকাবিলা নিয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ইশতিয়াক বারী।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০