গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ায় আপত্তি কেন

সুরাইয়া ইয়াসমিন তিথি: একসময় পুরো রাজধানীতেই ছিল লোকাল বাসের দাপট। আর সব গণপরিবহনেই শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল হাফ ভাড়া। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র দেখালেই বাসে কন্ডাক্টরা হাফ ভাড়া নিত। বহু বছর ধরেই শিক্ষার্থীরা এই সুবিধা পেয়ে আসছিল। তবে কোনো কোনো পরিবহন এ সুবিধা দিত না। এ নিয়ে চলত তর্ক-বিতর্ক ও ঝামেলা। এ ঝামেলা কখনও কখনও বড় আকারও ধারণ করেছে; বেধে গেছে ছাত্র-শ্রমিক সংঘর্ষ। এমন ঘটনা অনেক রয়েছে। বাসে হাফ ভাড়ার বিষয়ে কন্ডাক্টরদের দাবি, মালিকের নিষেধ আছে হাফ ভাড়া নেয়ায়। আবার রাজধানীর অনেক বাসের দরজায় লেখা রয়েছে, ‘হাফ পাস নেই,’ অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ায় যাতায়াতের কোনো সুযোগ নেই। তার পরও কোনো কোনো বাস হাফ ভাড়া নেয়, আবার কোনোটা নেয় না। আবার অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, যাওয়ার পথে যে শিক্ষার্থী হাফ ভাড়া দিয়েছে, কিন্তু ফেরার পথে তাকে একই পরিবহনে পূর্ণ ভাড়া দিতে হচ্ছে। পরিবহন খাতে নানা নৈরাজ্যের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিয়েও চলছে এক ধরনের নৈরাজ্য।

বর্তমানে সিটিংয়ের নামে অভিনব কৌশল অবলম্বন করছেন গণপরিবহনের লোকেরা। ফলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কন্ডাক্টরের প্রতিনিয়ত ঘটছে অপ্রীতিকর ঘটনা। বাসমালিকদের এই আচরণে ক্ষুব্ধ যাত্রীরাও। শুধু তা-ই নয়, ওইসব বাস সার্ভিস স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী দেখলেই বাসে তুলতে চায় না। আবার নিজেকে ছাত্র পরিচয় দিয়ে কেউ হাফ ভাড়া দিতে চাইলে কন্ডাক্টর ক্ষেপে গিয়ে খারাপ ব্যবহারও করে; কখনও কখনও ধাক্কা দিয়েও ফেলে দেয় বাস থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনায় শিক্ষার্থীরা শারীরিকভাগে নিগৃহীত হয়েছে পরিবহন শ্রমিকদের হাতে। ছাত্রদের জন্য হাফ ভাড়া সরকার অনেক আগে করে রেখেছে, কিন্তু বাসশ্রমিকরা সরকারের নির্দেশনা অগ্রাহ্য করছে। হাফ ভাড়া নেই, কিন্তু সিটিং সার্ভিসের কথা বললেও দাঁড়িয়ে আসতে হয়, তাও আবার পুরো ভাড়া দিয়ে।

সরকার এমনিতেই সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়িয়েছে। এই বাহানা তুলে এখন আবার বাসমালিকদের চাপে গণপরিবহনের ভাড়াও বাড়িয়েছে। যেখানে স্টুডেন্ট ভাড়া ১০ টাকা ছিল, সেখানে এখন আড়াই গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে যাওয়া লাগবে। ছাত্রাবস্থায় বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর হাতেই খুব সীমিত পরিমাণে টাকা থাকে। বাবা-মায়ের দেয়া টাকাই তাদের খরচের প্রধান উৎস। এর বাইরে টিউশনি বা অন্য কোনো সোর্স থেকে প্রাপ্ত টাকার পরিমাণও খুব বেশি হয় না। বাস ভাড়ার জন্য শুধু বাসে যাতায়াতের জন্যই যদি রাস্তায় প্রতিদিন গুনতে হয় ৫০ থেকে ৮০ টাকার মতো, তবে মাসে এর পরিমাণ দাঁড়ায় এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার ৪০০ টাকায়, যা বহন করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। তাই স্টুডেন্ট ভাড়া যৌক্তিক দাবি। এ ক্ষেত্রে বাস কন্ডাক্টর যদি আইডি কার্ডও দেখতে চায় তাও গ্রহণযোগ্য। ঢাকার রাস্তায় সিটিং সার্ভিস নামে যে বাস চলে, তা রীতিমতো ডাকাতি! এ সিটিং সার্ভিস প্রথা তুলে দেয়া উচিত। নারীদের দুর্ভোগ আরও বেশি; নারী যাত্রীরা পুরুষের মতো লড়াই করে বাসে উঠতে ও নামতে অস্বস্তিতে পড়ে। বাড়তি ঝামেলা মনে করে অনেক বাসই নারী যাত্রীদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। আর নারী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে হাফ ভাড়া যেন অমাবস্যার চাঁদ। ছাত্ররা অনেক সময়ই অধিকারের জোর দেখাতে পারলেও ছাত্রীদের অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হয় হেলপারদের দৌরাত্ম্যের কাছে। ঢাকার একটা বড় অংশের শিক্ষার্থীদের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় এসব গণপরিবহনে যাতায়াত করতে হয়। এ কথা সত্য যে, দিন দিন শিক্ষা ব্যয় বাড়ছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার সঙ্গে এক্ষেত্রেও ব্যয় বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। অনেক পরিবারের পক্ষে সন্তানের শিক্ষা ব্যয় মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকের জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে সন্তানের লেখাপড়ার ব্যয় মেটানো। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিবহন ভাড়াও বেড়েছে। হাফ ভাড়ার কথা বলাও যায় না এসব বাসের হেলপারদের সঙ্গে, বললেই নেমে যেতে বলে। এদের কাছে অসহায়ভাবে জিম্মি আমরা। অথচ পরিবহন মালিক বা কোম্পানিগুলো এদেশের সাধারণ মানুষের সন্তানদের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের নিজস্ব কোনো আয়ের উৎস না থাকায় দীর্ঘ দিনের একটা দাবি ছিল শিক্ষার্থীদের ‘হাফ পাস’ নেয়া। সরকার এই দাবি কখনোই কর্ণপাত করেনি।

বেশিরভাগ বাস যেখানে একটা যাত্রী পাবে, সেখান থেকেই তুলে নেবে। মিনিটে মিনিটে রাস্তার মাঝখানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী তুলে নেয়; যেখানে একটা মানুষ পাবে, সেখান থেকেই তুলে নেবে। বাসে লোক তোলার জায়গা না থাকলেও দরজায়ও জায়গা করে নেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য ছাদে উপায় নেই নেয়ার, না হয় সেখানেও নিত। তুলতে তুলতে বাসে লোক তোলার জায়গা না থাকলেও দরজায়ও জায়গা করে নেয়। তখন ইঞ্জিনেও যাত্রী বসানো হয়, যা মোটেও নিরাপদ নয়। এমনকি দরজার পাশে যাত্রী ওঠানামার পথেও যাত্রীকে বসানো হয়। শুধু যে শিক্ষার্থী তা নয়, বয়স্ক শিশু-নারী সবাই এ অবস্থার ভুক্তভোগী। সিটিং সার্ভিসের বালাই না থাকলেও ভাড়ায় কোনো কম নেই। যিনি গোটা পথ দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন তাকেও একই ভাড়া গুনতে হয়। রাজধানীর ২৪৬টি রুটে চলাচল করে প্রায় আট হাজার বাস। এর মধ্যে মাত্র ১২টি রুটে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ পাস চালু আছে। ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) চারটি বাসের মাধ্যমে সরকারিভাবে গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু করে। মূলত তখন থেকে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বেসরকারি গণপরিবহনের সঙ্গে সরকার চুক্তি করে থাকে। সরকারের চুক্তি এবং লিখিত কোনো আইন না থাকার কারণে হাফ ভাড়ার এই প্রথাটা ধীরে ধীরে উঠে যেতে থাকে।

কিছু দিন আগের কথা, শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে ৯ দফা দাবি তোলে। এর মধ্যে একটি দাবি ছিলÑ‘প্রতিটি বাসে স্টুডেন্টদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’ আন্দোলন স্থগিত হয়েছে অনেক দিন হলো, এখনও গণপরিবহনগুলোয় হাফ ভাড়া নেয়া হয় না। বিদ্যালয় অবকাঠামো থেকে শুরু করে শিক্ষা উপকরণে এসেছে আধুনিকতা। প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষার্থীরা আর্থিকভাবে উপকৃত হয়, এমন সুবিধা নিশ্চিত করেছে সরকার। শিক্ষার্থীদের সামান্য সহযোগিতা হিসেবে অর্ধেক পরিবহন ভাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিবহন মালিকরাও এক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। ভবিষ্যৎ জাতির কর্ণধার বিনির্মাণে বাস মালিকদের এগিয়ে আসতে হবে।

গণপরিবহনের হাফ পাস শিক্ষার্থীদের আবদার নয়, এটা এক ধরনের অধিকার। অথচ নিজেদের এমন অধিকার আদায় করতে গিয়ে সড়কে প্রাণ দিতে হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীকে। ন্যায্য অধিকার হিসেবে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ পাস ব্যবস্থা পুরোদমে চালু করার দাবি সাধারণ শিক্ষার্থীদের। উন্নত বিশ্বের দেশ, যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় ছাত্রছাত্রীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা চালু রয়েছে; অথচ বাংলাদেশে বিষয়টি নিয়ে নানা ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। নানা সময় ঘটছে প্রাণহানিও। হাফ পাসের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গেলে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সরকারের কাছে নানা দাবিও তুলে ধরে শিক্ষার্থীরা। সরকারি বাসে চালু হয় একসময় শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ পাসের প্রচলন। কিন্তু এটা ছিল সম্পূর্ণ সরকারি সেবা। পরবর্তী সময়ে যখন সরকারি বাসের পাশাপাশি বেসরকারি বাস গণপরিবহনের সেবা দেয়া শুরু হয়, তখন সরকারি বাসের নিয়মে বেসরকারি বাসেও ছাত্রদের হাফ ভাড়া নেয়া হতো। কিন্তু এ বিষয়ে যেহেতু কোনো লিখিত নিয়ম নেই, তাই এটা একটা প্রথা হয়ে দাঁড়ায়, যেটা পরবর্তীকালে বেশ কিছুদিন চলে। কিন্তু সরকার যেহেতু বেসরকারি বাস কোম্পানির সঙ্গে কোনো চুক্তি করেনি সেহেতু এই হাফ ভাড়া নিতে তারা বাধ্য নয়। তবে সাধারণ যাত্রীদের সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে বেসরকারি গণপরিবহন সঙ্গে সরকারের যদি চুক্তি থাকত, বিআরটিএ’র নির্ধারিত ভাড়া ছাড়া অতিরিক্ত ভাড়া না নেয়াসহ ছাত্রদের হাফ ভাড়া বিষয়ে চুক্তি থাকত, তাহলে ভালো হতো এবং এত তর্কবিতর্ক হতো না। গণপরিবহনগুলোয় বড় করে লেখা থাকে ‘হাফ পাস নেই’, যা শিক্ষার্থীদের গণপরিবহনে যাতায়াত করতে বিড়ম্বনায় ফেলে এবং প্রায়ই পরিবহন স্টাফদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বাকবিতণ্ডা হয়, যা কখনোই কাম্য নয়। তাই অবিলম্বে অতিরিক্ত বাস ভাড়া প্রত্যাহার ও শিক্ষার্থীদের ‘হাফ পাস’ নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যৎ জাতির কর্ণধার বিনির্মাণে শিক্ষার্থীদের জন্য ‘হাফ পাস’ সুবিধাদানে সদাশয় সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নেবে বলেই প্রত্যাশা।

শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০