Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 2:46 pm

গণহত্যা: অক্টোবর ’৭১

কাজী সালমা সুলতানা: বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বিনাশ করতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একাত্তরের প্রায় সারা বছর ধরেই সমগ্র দেশজুড়ে নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে গণহত্যার পরিসমাপ্তি ঘটে। এসব গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ শহিদ হয়েছেন বলা হলেও বাস্তবে এই সংখ্যা ৩০ লাখেরও বেশি। এখন পর্যন্ত দেশে পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত হয়েছে। দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকবর। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের শেষ দিকে আরও কয়েকটি গণহত্যা সংঘটিত হয়।

নাগরপুর গণহত্যা: ১৯৭১ সালের ২৫ অক্টোবর টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার গয়হাটা ইউনিয়নের বনগ্রামের রসুলপুর গ্রামে গণহত্যা সংঘটিত হয়। ১৯৭১ সালের ২১ অক্টোবর বনগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নিয়েছে এমন সংবাদ পেয়ে সিরাজগঞ্জ থেকে গানবোট নিয়ে পাক হানাদার বাহিনী বনগ্রাম আক্রমণ করে। শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর ১ জন মেজরসহ ৩ জন নিহত হয়। আর মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে শহিদ হন জেলার কালিহাতী উপজেলার নজরুল ইসলাম নজু, মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার জাহাঙ্গীর আলম, আকতারুজ্জামান ও ওহাব আলীসহ ৭ জন। অবস্থা বেগতিক দেখে পাক হানাদার বাহিনী পিছু হটে নিজ ক্যাম্পে ফিরে যায়। পরে পাক সেনারা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে ২৫ অক্টোবর রাতে বনগ্রাম আক্রমণ করে। মুহুর্মুহ গুলি ও অগ্নিসংযোগে বনগ্রাম ও আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। হামলায় নিরীহ গ্রামবাসীসহ ৫৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এছাড়া  ১২৯টি বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে দেয় ও বহু গবাদি পশুও পুড়িয়ে মারে। হত্যাযজ্ঞের পর হানাদার বাহিনী চলে গেলে গ্রামবাসীর সহায়তায় শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের একত্রে মাটি চাপা দেয়া হয়। স্বাধীনতার পরে ওই স্থানটি বনগ্রাম গণকবর হিসেবে নামকরণ করা হয়।

ঝানজিরা গণহত্যা: মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সব জায়গায় গণহত্যা হয়েছে। দিনাজপুরও এর বাইরে ছিল না। এই জেলা সদরের ঝানজিরা, রানীগঞ্জ, কমলপুর, মোহনপুর, খানপুর, রামসাগর, কাঞ্চনঘাট ও রেল সেতু এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় হাজার হাজার নিরীহ মানুষ পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসরদের হাতে গণহত্যার শিকার হয়েছেন। এসব গণহত্যার মধ্যে দিনাজপুর সদর উপজেলার ঝানজিরা গণহত্যা সবচেয়ে বেশি  উল্লেখযোগ্য।

২৮ অক্টোবর’ ৭১। রমজান মাসের মাঝামাঝি সময়। আগের দিন মুক্তিবাহিনী দামাল ছেলেরা ঝানজিরা ছেড়ে চলে যায়। ঠিক তার পরদিন সেহেরি খাবার সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকার বাহিনী পুরো গ্রাম ঘেরাও করে। এরপর তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ৬০-৭০ জনকে ধরে নিয়ে এসে জড়ো করে স্থানীয় পেতব উদ্দীন শাহের বাড়ির উঠানে। এরপর তারা গ্রামটির ১০০-১৫০ জনের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি সেখানকার নারীদের  ওপর চলে নিষ্ঠুর নির্যাতন। আগুনে পুড়ে অনেকের মৃত্যু হয়। ঝানজিয়ার গণহত্যার নেতৃত্বে ছিল মেজর নাসিরের নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনী।   

বিটঘর গণহত্যা: মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় যে কয়টি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে সবচেয়ে ভয়ংকর ও লোমহর্ষক হলো সরাইল উপজেলার বিটঘর গণহত্যা। সরকারি হিসেবে এখানে ৮০ জনকে হত্যার কথা উল্লেখ থাকলেও এলাকাবাসীর দাবি এ সংখ্যা শতাধিক।

৩১ অক্টোবর, ১৯৭১। সকালবেলা সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশুগঞ্জ থেকে দুই শতাধিক সৈনিক বিটঘর গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে। রাজাকাররা পথ দেখিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে সেখানে নিয়ে আসে। পাকিস্তানি সৈনিক ও রাজাকাররা ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে নিরীহ গ্রামবাসীকে ছোট খালের পূর্ব পাশে জড়ো করে। তারপর বহু লোককে একসঙ্গে লাইনে দাঁড় করিয়ে পর্যায়ক্রমে গুলি করতে থাকে। লাইনে থেকে দৌড়ে পালিয়ে গিয়ে ঘটনাচক্রে বেঁচে যান মন্তাজ উদ্দিন, আশকর আলী ও সফর আলী। এ ঘটনায় গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারেরই একাধিক লোক নিহত হয়েছেন। নির্যাতিত হয়েছেন গ্রামের আরও অনেক নারী-পুরুষ।

পাক হানাদার বাহিনী সরাইল থেকে হেঁটে এবং জাফর নদী দিয়ে নৌকায় এই গ্রামে প্রবেশ করেন। তারপর তারা লোকজনকে বাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে ধরে নিয়ে ছোট খালের পাড়ে হত্যা করেছে। লাশ খালের পানিতে ফেলে দিয়েছে। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মানুষ হত্যা করেছে। তারা গ্রামের পুরুষ লোক যাকেই পেয়েছে তাকেই ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। বিটঘর গ্রামের ছেলামত আলীকে পাকিস্তানিরা চড় মেলে ফেলে দেয়। তারপর বুট-জুতা দিয়ে লাথি মারে। তার চোখের সামনে তিন ভাইকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে হত্যা করেছে। হত্যা করা হয়েছে ছেলামত আলীর পাঁচ মামাকে। এই ছেলামত আলীর বাড়ির সামনে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এই মর্মান্তিক ঘটনার পর যখন তার তিন ভাইয়ের লাশ তুলে দাফনের বন্দোবস্ত করা হয় ঠিক তখনই গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, পাকিস্তানি বাহিনী আবার এসেছে। সেই সময় অন্য সবাই লাশ ফেলে পালিয়ে যায় জীবন বাঁচাতে। সবাই মিলে লুকায় পাশের ধানক্ষেতে। পরবর্তী সময়ে এলাকাবাসীর সহায়তায় সেই তিনজনকে এক কবরে দাফন করা হয়।

পানিস্বর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য বিটঘর গ্রামের আজিজুল হক জানান, বিটঘর গণহত্যার আগের দিন শুনতে পেলাম আমাদের গ্রামের পাশের  গ্রাম দুর্গাপুর মোল্লা বাড়ির পাশে একজন পাকিস্তানি সৈনিককে হত্যা করা হয়েছে। ভুল তথ্যের কারণে পাকিস্তানি বাহিনী দুর্গাপুর মোল্লাবাড়িতে না গিয়ে বিটঘর মোল্লাবাড়িতে আক্রমণ করে। পরে এই আক্রমণ সব গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। ওই আক্রমণে শহিদ ৮০ জনের মধ্যে এক মায়ের চার সন্তান ছিল। চার সন্তানকে হারিয়ে তাদের মা খালেক ডাক্তারের স্ত্রী পাগল হয়ে যান। আমৃত্যু তিনি পাগলের মতো চার সন্তানের কবর আঁকড়ে ধরে বিলাপ করেছেন।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা দেশজুড়ে যে গণহত্যা চালায়, তা ইতিহাসের নির্মম ঘটনা। সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অসংখ্য নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকেও হার মানায়। বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা যাদের হারিয়েছি তাদেও সবাইকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। তারাই অনুপ্রেরণা হয়ে ভবিষ্যৎ প্রজš§কে পথ দেখাবে।

সূত্র: ১৯৭১ গণহত্যা ও নির্যাতন আর্কাইভ ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ট্রাস্ট

সাংবাদিক

salma15august@gmail.com