রোহান রাজিব: জাতীয় নির্বাচনের পরও গতি আসেনি বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিতে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে এ খাতে ঋণের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসের (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) হিসাবে এ খাতে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ৬ শতাংশের বেশি ছিল। মূলত ডলার সংকট ও সুদের হার বৃদ্ধির কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ হচ্ছে না। এর প্রভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলতি মুদ্রানীতি আরও সংকোচনমূলক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নীতির উদ্দেশ্যই হলোÑসুদহার বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারে অর্থের সরবরাহ কমিয়ে আনা। এ লক্ষ্যে নীতি সুদহার কয়েকদফা বাড়ানোও হয়েছে। এতে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সুদহার প্রতি মাসেই বাড়ছে। আর সুদের হার বৃদ্ধির কারণে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে কম আগ্রহী হচ্ছেন। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক খাতে ডলার ও নগদ টাকার সংকট চলছে। ফলে গ্রাহক পর্যায়ে চাহিদ অনুযায়ী ঋণ বিতরণ ও প্রয়োজনীয় এলসি খুলছে না অনেক ব্যাংক। এসব কারণে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী প্রবণতায় রয়েছে।
চলতি মুদ্রানীতিতে আগামী জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ শতাংশ। আগের মুদ্রানীতিতে এই লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ১১ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ফেব্রুয়ারি শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকায়; যা ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছিল ১৪ লাখ ৩৪ হাজার ৬৯ কোটি টাকা। ফলে গত এক বছরের ব্যবধানে বেসরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। আগের মাসে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ। অথচ গত বছরের ডিসেম্বরে এ খাতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। এবার অর্থবছরের হিসাবে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি আরও নিম্নমুখী। চলতি অর্থবছরের আট মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৬ দশমিক ১৩ শতাংশ। আর গত অর্থবছরের পুরো সময়ে ছিল ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, বেসরকারি খাতের ঋণের বড় অংশ ব্যয় হয় আমদানিতে। তবে ডলার-সংকটের কারণে চাহিদামতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। সেই সঙ্গে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, ডলারে কেনায় খরচ বৃদ্ধি ও সরকারের ব্যাংকঋণ বাণিজ্যিক ব্যাংকনির্ভর হওয়ায় ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট চলছে। অন্যদিকে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণে ধারাবাহিকভাবে ঋণের সুদহার বৃদ্ধি পাওয়ায় ঋণের চাহিদা কম হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) আমদানি ঋণপত্র নিষ্পত্তির পরিমাণ কমেছে ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এ সময় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ঋণপত্র কমেছে ২৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র কমেছে ২৫ দশমিক ০৬ শতাংশ। আর শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি কমেছে ৮ দশমিক ৮২ শতাংশ।
তথ্য পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি টানা কমতে থাকে। ওই মাসে বেসরকারি খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ। এরপর ফেব্রুয়ারিতে ১২ দশমিক ১৪, মার্চে ১২ দশমিক ০৩, এপ্রিলে ১১ দশমিক ২৮, মে মাসে ১১ দশমিক ১০ এবং জুনে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশে নেমে যায়। এরপর জুলাইয়ে দুই অঙ্কের নিচে নেমে যায় প্রবৃদ্ধি। ওই মাসে প্রবৃদ্ধি কমে হয় ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। আগস্টে তা আরও কমে ৯ দশমিক ৭৫ ও সেপ্টেম্বর ৯ দশমিক ৬৯ নেমে আসে। তবে অক্টোবরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে ১০ শতাংশের ঘরে উঠেছিল। এর পরের মাস নভেম্বরে আবার তা কমে ৯ দশমিক ৯০ শতাংশে নেমে আসে। এর পরের মাস ডিসেম্বরে প্রবৃদ্ধি আবার ১০ শতাংশের ঘরে ওঠে। ওই মাসে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয় ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ফের এক অঙ্কের ঘরে নেমে আসে ঋণের প্রবৃদ্ধি। এজন্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকেও দায়ী করা হয়।
বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমলেও উল্টো চিত্র সরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকারি খাতে নিট ঋণের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২২ দশমিক ৪৭ শতাংশ, যা আগের মাসেও ছিল ২১ দশমিক ১৩ শতাংশ। আর গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ১৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ।