গতি নেই দ্বিতীয় মেয়াদের প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে

জয়নাল আবেদিন: প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় বিতরণকৃত ঋণ আদায় নিয়ে চিন্তিত ব্যাংক খাত। তাই ব্যাংকগুলো নতুন করে ঋণ দিতে দ্বিধাদ্বন্ধে ভুগছে। ব্যবসা খারাপ হওয়ার কারণে অনেক গ্রাহক অর্থ ফেরত দিতে পারছেন না। ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের সার্বিক আদায়ে। তাই নতুন করে ঋণ দিতে সাহস পাচ্ছে না অনেক ব্যাংক।

কভিডে সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলায় দ্বিতীয় ধাপে প্রণোদনার ঋণ বিতরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি বছর ১ জুলাই থেকে দ্বিতীয় মেয়াদের ঋণ বিতরণ শুরু হলেও কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। তবে প্রথম মেয়াদে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ প্রায় ৮০ শতাংশ বাস্তবায়নে সক্ষম হয় ব্যাংক খাত। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তথ্য বলছে, তিন মাস পার হয়ে গেলেও দ্বিতীয় মেয়াদে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের হার ১ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানের জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে প্রথম মেয়াদে ৪০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছিল। এর বাস্তবায়ন হার ছিল ৮১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তবে ১ জুলাই থেকে দ্বিতীয় মেয়াদের প্যাকেজ বাস্তবায়ন শুরু হলেও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ খাতে বিতরণ হয়েছে মাত্র ৫১৯ কোটি টাকা, যা দ্বিতীয় মেয়াদে এ খাতে নির্ধারিত প্যাকেজের ১ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ সুবিধা দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে এখন পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে মাত্র ৪৭৭ কোটি টাকা, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিমের ঘোষণা করা হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। এ প্যাকেজের আওতায় এখন পর্যন্ত সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৬৫টি প্রতিষ্ঠান। এখন পর্যন্ত ৩৭৫ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা পেয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৭ দশমিক ৫১ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণ বিতরণ করে তা আদায় হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না। তাই দ্বিতীয় মেয়াদে নতুন ঋণ দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না ব্যাংক।

করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় প্রথম মেয়াদে সরকার মোট ২৮টি প্যাকেজ ঘোষণা করে। সবমিলিয়ে এসব প্যাকেজের অর্থের পরিমাণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকার নয়টি প্যাকেজ বাস্তবায়ন হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে। বছর শেষে এসব প্যাকেজের সার্বিক বাস্তবায়নের হার ছিল প্রায় ৮০ শতাংশ।

ঋণ হিসেবে বিতরণযোগ্য প্রতিটি প্রণোদনা প্যাকেজের জন্য গত বছর এপ্রিলে পৃথক নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। নীতিমালায় বলা হয়েছিল, প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর মেয়াদ হবে তিন বছর। তবে একজন উদ্যোক্তা কেবল এক বছরের জন্য স্বল্প সুদের ঋণ সুবিধা ভোগ করবেন। ঋণ বিতরণের দিন থেকে এক বছর পার হলে সে ঋণের বিপরীতে সরকার থেকে কোনো সুদ ভর্তুকি দেয়া হবে না। ঋণটি আদায় না হলে সেটি বিতরণকারী ব্যাংকগুলোর স্বাভাবিক ঋণ বলে গণ্য হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারিকৃত নীতিমালার আওতায় এরই মধ্যে বৃহৎ শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ঘোষিত ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে বিতরণকৃত বেশিরভাগ ঋণের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এজন্য দ্বিতীয় মেয়াদে ওই প্যাকেজ থেকে ঋণ বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ প্যাকেজ থেকে একজন উদ্যোক্তা তার ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ ঋণ নিতে পারবেন। এ হিসাবে যদি কোনো উদ্যোক্তা এরই মধ্যে ৩০ শতাংশ ঋণ নিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি দ্বিতীয়বার প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে কোনো ঋণ নিতে পারবেন না। প্রথমবার যদি কোনো উদ্যোক্তা ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের ৩০ শতাংশ অর্থ না নিয়ে থাকেন, তবে দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি অবশিষ্ট অংশের ঋণ নিতে পারবেন বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

প্রণোদনার ঋণ পরিশোধের নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও বেশিরভাগ গ্রাহক পরিশোধ করতে পারছেন না। উল্টো এখন ব্যাংকের কাছে বাড়তি সময় চাচ্ছেন তারা। এতে উভয় সংকটে পড়েছেন ব্যাংকাররা। এক দিকে সময় বাড়িয়ে না দিলে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাবে, এতে বাড়তি প্রভিশন রাখতে গিয়ে কমে যাবে আয়।

অপরদিকে, বাড়তি সময় দিলে ঋণ আদায়ের হার কমে যাবে। এতে প্রভাব পড়বে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতার ওপর। এরপরও গ্রাহকদের চাপে বাধ্য হয়েই ব্যাংকগুলো এক বছর সময় বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এতেও সন্তুষ্ট নন অনেক গ্রাহক। তারা দুই বছর সময় চাচ্ছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার বাধ্যবাধকতায় এক বছরের বেশি বাড়ানো যাবে না। সবমিলিয়ে প্রণোদনার ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়েছে দেশের ব্যাংক খাত।

কভিড মহামারিতে ২০২০ সাল থেকে সংকটে পড়ে রপ্তানির সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাক শিল্প। মহামারির এ ধাক্কা সামলাতে অন্যান্য খাতের পাশাপাশি এ খাতটির জন্যও আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করেছে সরকার। তবে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আরও কিছু সুবিধা চাইছেন তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরা। এর অংশ হিসেবে চলতি বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত সব ধরনের সুদ ও কস্ট অব ফান্ডসহ সব চার্জ মওকুফ চান তারা।

মওকুফের পর অবশিষ্ট ঋণকে ২০২২ সালের জানুয়ারিভিত্তিক স্থিতির ওপর ২ শতাংশ হারে ডাউন পেমেন্টে দুই বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছর মেয়াদে ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলীকরণের দাবি জানিয়েছে পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। সম্প্রতি অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ তালুকদারের কাছে সংগঠনের বিভিন্ন দাবি তুলে ধরে চিঠি দিয়েছে বিজিএমইএ। যদিও ব্যাংকাররা বলছেন, এ প্রস্তাব গ্রহণ করা হলে ব্যাংক খাত দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিতে পড়বে।

এ প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘জুন পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা ছিল। কিস্তির ২৫ শতাংশ দিলেই গ্রাহককে নিয়মিত রাখার নির্দেশনা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ব্যাবসা ভালো না হওয়ায় এই সময়ের মধ্যে অনেকেই টাকা পরিশোধ করতে পারেনি।’

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দ্বিতীয় প্রজন্মের এক বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন, প্রথম মেয়াদে প্রণোদনার যেসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে সেগুলোই ঠিকঠাক আদায় হচ্ছে না। কিস্তি দিতে পারছেন না গ্রাহক। তাই নতুন করে ঋণ দিতে ভয় পাচ্ছে ব্যাংক।

তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিল থেকে নিয়ে যেসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, এক বছর অতিক্রম করলেই বিতরণকৃত ঋণের টাকা কেটে নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু গ্রাহকের কাছ থেকে ব্যাংক টাকাটা ফেরত পাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে কোনো ব্যাংকই নতুন করে ঝুঁকি নিতে চাইবে না।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০