গবেষণায় উৎপাদন বৃদ্ধি হলেও ভরা মৌসুমে ইলিশের আকাল

বেলায়েত সুমন, চাঁদপুর: বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) কর্তৃক বাস্তবায়িত চাঁদপুর নদী কেন্দ্রে ইলিশ গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্পে গবেষণার নামে ক্রয় প্রক্রিয়াসহ অঙ্গভিত্তিক সীমাহীন অনিয়ম আর লুটপাটের কারণে ভেস্তে গেছে প্রকল্পের লক্ষ্য উদ্দেশ্য। ফলে ভরা মৌসুমেও কাগজে-কলমে গবেষণাগারে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও বাস্তবে ইলিশের বাড়ি খ্যাত চাঁদপুরের ৭০ কিলোমিটার অভয়াশ্রম এলাকায় দেখা দিয়েছে ইলিশের আকাল।

সূত্রমতে, বিএফআরআই কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘চাঁদপুর নদী কেন্দ্রে ইলিশ গবেষণা জোরদারকরণ (২য় সংশোধিত)’ শীর্ষক প্রকল্পটি মোট ৩৩ কোটি ৫৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জুলাই ২০১৭ হতে জুন ২০২১ পর্যন্ত মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদিত হয়। পরবর্তী সময়ে প্রথম সংশোধিত ডিপিপি ৩৮ কোটি ৫৬ লাখ ৫৭ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে এবং ২য় সংশোধিত ডিপিপি ৩৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জুন ২০২২ পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করে পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত হয়।
২০২১-২২ অর্থবছরের এডিপিতে প্রকল্পের অনুকূলে ৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। নভেম্বর ২০২১ পর্যন্ত প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৯ কোটি ৯০ লাখ ৫ হাজার টাকা; যা বরাদ্দের ১৫ শতাংশ। প্রকল্পের শুরু থেকে নভেম্বর ২০২১ পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিত আর্থিক অগ্রগতি ছিল ২৭ কোটি ৭২ লাখ ২২ হাজার টাকা; যা অনুমোদিত প্রকল্প ব্যয়ের ৭৯ দশমিক ৮০ শতাংশ।

প্রকল্পের কার্যক্রম ২০২২ সালে শেষ হয়। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইলিশ গবেষণা জোরদারকরণের জন্য চাঁদপুর নদী কেন্দ্রে আধুনিক গবেষণা ভেসেল কেনাসহ অন্যান্য অবকাঠামো স্থাপন। ইলিশ সম্পদ সংরক্ষণ এবং উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যথাযথ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের লক্ষ্যে যুগোপযোগী গবেষণা পরিচালনা এবং ইলিশ সম্পদ সংরক্ষণ এবং উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারকে প্রযুক্তিভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান, আধুনিক গবেষণা ভেসেল সংগ্রহ, পন্টুন, স্পিডবোট, মোটরসাইকেল ক্রয়, কেন্দ্রের গবেষণা কার্যক্রম জোরদারকরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ (এ-টাইপ ডুপ্লেক্স ভবন, ডরমেটরি কাম ট্রেনিং ভবন, মেশিনারি এবং ফিড স্টোর, ইলেকট্রিক সাব-স্টেশন ভবন, ভেসেল ঘাটের জন্য বার্থিং স্ট্রাকচার, গভীর নলকূপ স্থাপন করা।

এর মধ্যে ৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি গবেষণা জাহাজ ক্রয় করা হলেও প্রকল্পে গবেষণাসহ অন্যান্য অঙ্গভিত্তিক খাতে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। যদিও এ প্রকল্পের আওতায় মোট ৯টি গবেষণা কাজের মধ্যে জুন ২০২১ পর্যন্ত ৬টি সমাপ্ত এবং তিনটি চলমান রয়েছে বলে ১০ জানুয়ারি ২০২২ সালের স্টিয়ারিং কমিটির ষষ্ঠ সভায় উপস্থাপন করা হয়। গবেষণা কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়ন শেষ হলে ইলিশের আহরণ মাত্রা, সর্বোচ্চ টেকসই উৎপাদন, জীবনভর নির্ধারণ, ইলিশ মাছের অকাল ডিম্বাশয়ের পরিপক্বতার কারণ নির্ণয় করা যাবে; যা ভবিষ্যতে ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল নীতি বা কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরাÑএমন দাবি করলেও বর্তমানে কাগজে-কলমে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও ভরা মৌসুমে চাঁদপুরে ইলিশের আকাল দেখা দিয়েছে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে চাঁদপুর নদী কেন্দ্রে ইলিশ গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্পের কার্যক্রম শুরুর বছর ইলিশের উৎপাদন ছিল অন্যান্য বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ। অভ্যন্তরীণ জলাশয় ও সামুদ্রিক জলাশয়ে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ইলিশের মোট উৎপাদন হয়েছে ৪ লাখ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন। বৃদ্ধির হার ২৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫ লাখ ১৭ হাজার মেট্রিক টন। বৃদ্ধির হার ৪ দশমিক ১৯ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫ লাখ ৩২ হাজার মেট্রিক টন। বৃদ্ধির হার ৩ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। বৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৩১ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৬৫ লাখ মেট্রিক টন। বৃদ্ধির হার ২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৬ হাজার মেট্রিক টন। বৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৭১ লাখ মেট্রিক টন। বৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ।

অপরদিকে ২০২২ সালের ১০ জানুয়ারি স্টিয়ারিং কমিটির ষষ্ঠ সভায় প্রকল্প পরিচালক মো. আবুল বাশার জানান, প্রকল্পের আওতায় অন্যতম প্রধান কার্যক্রম হলো গবেষণা জাহাজ নির্মাণ/সংগ্রহ। ওই সভায় সভাপতি বলেন, প্রকল্পের অর্থায়নে যেসব গবেষণা কার্যক্রম নেয়া হয়েছে তা পৃথকভাবে দেখাতে হবে, রাজস্ব বাজেট ও উন্নয়ন বাজেটে চলমান গবেষণার দ্বৈততা পরিহার করতে হবে। সব গবেষণার ফলাফল প্রকাশনার আকারে সংরক্ষণ করতে হবে; যাতে পরবর্তী সময়ে তার ফলোআপ করা যায়। ইলিশের কতটি প্রজাতি রয়েছে তা যাচাই করতে হবে এবং প্রতিটি প্রজাতির জন্য ভিন্ন ভিন্ন জিন ব্যাংক করতে হবে। গবেষণার ফলাফল আউটপুট হিসেবে প্রকল্প সমাপ্তি মূল্যায়ন প্রতিবেদনে (পিসিআর) অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যদিও অনুসন্ধানকালে প্রকল্পের লক্ষ্য উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের কোনো তথ্য সরবরাহ করেনি প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। তবে প্রকল্পের অর্থ ব্যয় করে ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বলেশ্বর নদীতে ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র সংরক্ষণবিষয়ক আড়ম্বরে কর্মশালা করে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

সূত্রমতে, বলেশ্বর ও বলেশ্বর নদীর মোহনা অঞ্চল নিয়ে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট ৩৩৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে ইলিশের প্রজননক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। ওই অঞ্চল থেকে বছরে প্রায় ৮০০ কোটি লার্ভি ইলিশ (জিরো প্লাস সাইজ) পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রতি বছর ৫০ হাজার মেট্রিক টন অতিরিক্ত ইলিশ উৎপাদন হওয়ার কথা বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ করা হচ্ছে। এর বাজার মূল্য প্রায় দুই হাজার ৬৪ কোটি টাকা বলা হলেও ইলিশের বাজার চাহিদা ও উৎপাদনের সঙ্গে এসব তথ্যের ব্যাপক অসামঞ্জস্য রয়েছে।

ইলিশ গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্পের পরিচালক এমএ বাশার শেয়ার বিজকে বলেন, প্রকল্পের আওতায় ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে বলেশ্বর নদীতে ইলিশ মাছের প্রজনন ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠায় ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। গবেষণায় জাটকার প্রাচুর্যতা, পানির ভৌত রাসায়নিক গুণাগুণ, প্লাংটন ও গাট কনটেন্ট, মাছের শ্রেণি দৈর্ঘ্য, প্রতি ইউনিটে মাছ ধরার প্রচেষ্টা, প্রজননত্তোর ইলিশের হার পর্যবেক্ষণ করার কথা বলা হয়েছে। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি ও সংরক্ষণে নদী কেন্দ্র চাঁদপুর থেকে পাঁচ বছর ধারাবাহিক গবেষণার কথা বলা হলেও ২০২২ সালের জানুয়ারিতে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক বরাবর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কেন্দ্রপ্রধানের স্বাক্ষরিত একপত্রে চাঁদপুরে ইলিশের বৃহত্তম বিচরণক্ষেত্র ও অভয়াশ্রম (ষাটনল হতে চর আলেকজান্ডার) নষ্টসহ নদীর জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এমনকি বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, মেঘনা নদীতে অনিয়ন্ত্রিত বালি উত্তোলনের ফলে প্রধান প্রজনন মৌসুমে চাঁদপুর অংশে ইলিশের প্রজনন ও বিচরণ মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে।

ফলে মাছের বিচরণ ও প্রজনন প্রক্রিয়া পাল্টে যাওয়াসহ ইলিশের উৎপাদন মেঘনা নদীতে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে বলেও সেই পত্রে উল্লেখ করা হয়। এতে বর্তমান সময়ে চাঁদপুরে মা ইলিশের আকাল দেখা দিয়েছে। এমনকি ছোট ছোট ইলিশ মাছ ধরা পড়ার খবর প্রচার করা হলেও একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট হাতিয়া সন্দ্বীপের ইলিশ কৌশলে চাঁদপুরের মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে নিয়ে এসে চাঁদপুরে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা রক্ষার অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে।

চাঁদপুরের নিবন্ধিত জেলে ও জেলে অধ্যুষিত হানারচর, ইব্রাহিমপুর, এখলাছপুর মহনপুর, চরভৌরবি, কাটাখালী, রাজরাজেশ্বর, ষাটনলের মৎস্যজীবীদের দাবি, চাঁদপুরে নদী এলাকায় ইলিশের আকাল দেখা দিয়েছে। বিগত প্রায় ৫-৬ বছর পর্যন্ত ক্রমেই ইলিশের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় মৎস্যজীবীদের অনেকেই মহাজনী দাদনের দায় থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০