ঢাকার পতিত নগর পরিসরে সহসা রাজধানী জেগে ওঠায় আবাসন ও নির্মাণ খাত হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। সেই বাতাবরণে জহুরুল ইসলামের সৃজনী পদক্ষেপ ছিল তুরুপের তাস। ক্ষুদ্র ঠিকাদারি দিয়ে শুরু। দেশের সীমানা মাড়িয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে তিনি গড়েছেন আকাশচুম্বী অট্টালিকা, সড়ক-মহাসড়ক, কল-কারখানা; এমনকি দেশের আঙিনায় বুলন্দ করেছেন বিদেশি বড়-প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক ও শৌখিন গাড়ির সমৃদ্ধি। রাজধানী ঢাকার নির্মাণ, আবাসন ও বিস্তৃতির বিবর্তনিক ইতিহাসের ধারাক্রমে জহুরুল ইসলাম তাই এক অবিচ্ছেদ্য প্রাসঙ্গিকতা।
দ্বিতীয় পর্ব…
মিজানুর রহমান শেলী: নারায়ণগঞ্জ কিংবা মুন্সীগঞ্জ ছিল এক সময় বাংলার রাজধানী। এই দুই রাজধানীকে কেন্দ্র করে ঢাকায় গড়ে উঠেছিল কিছু আবাসন। ঢাকার সেসব রাজধানী ঘেঁষা আবাসন ইতিহাস আজ প্রাচীন। তবে ঢাকা নিজেই রাজধানী শহরের আবাসন ইতিহাস হয়ে উঠেছে মোগল আমল থেকে। এ সময় থেকে এই ঢাকা বারবার উত্থান-পতনের জোয়ার-ভাটায় নিজ পরিসরে আন্দোলিত হয়েছে। যদিও ১৩ শতকের শেষের দিকেই ঢাকা মুসলিমদের বিজয় সীমানায় মিলিত হয়, তবুও ঢাকাকে মোগলদের সাম্রাজ্যে আসতে সময় লেগেছে ঢের। ১৩৩৮ সালে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ ওরফে ফখরা শামসদ্দিন মোবারক শাহের বর্মরক্ষক থেকে বিদ্রোহ করে স্বাধীন বাংলার গোড়াপত্তন করেন। সে থেকে পরের ২০০ বছর বাংলা ছিল স্বাধীন। তাছাড়া এর পরের সময়ে ঢাকা ছিল বারো ভুঁইয়াদের করতলগত। এ সময় থেকেই ঢাকা ছিল এক সুন্দর, জাঁকজমকপূর্ণ নগরীÑমির্জা নাথানের বাহারিস্তান-ই-গায়িবিতে তার বর্ণনা রয়েছে।
বারো ভুঁইয়ারা ছিল স্বাধীনচেতা। তারা মোগলদের বিরোধিতা করে আসছিল। সে সময় মোগলরা বারবার ঢাকায় অভিযান পাঠিয়েও নিজ সীমানাবদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ১৫৭৬ থেকে ১৬০৫ পর্যন্ত তারা কেবল ব্যর্থ অভিযানেই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হন। পরে জাহাঙ্গীরের নিযুক্ত শাসনকর্তা ইসলাম খান চিশতি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করেন। এটি ছিল ১৬০৮ সাল। এর পাঁচ বছরের মধ্যেই ঢাকা তথা পুরো বাংলায় বারো ভুঁইয়াদের পতন ঘটে। বলা চলে এই ১৬০৮ সাল থেকেই ঢাকা হয়ে ওঠে রাজধানীÑতবে নগর ইতিহাস চৌদ্দ শতক থেকেই। যাহোক এই রাজধানী ঢাকা মোগল আমলে বারবার ম্রিয়মাণ হয়েছে। কেননা সুবা বাংলার সুবাদারদের বারবার পরিবর্তন করা হতো। ফলে প্রশাসনিক এবং বাণিজ্যিক সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গে এখানে বিভিন্ন দেশ, জাতি ও পেশার মানুষের সংশ্রবে এসেছে উচাটানের গতিধারা। আবার রাজনৈতিক পালা বদলে এখানে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। ব্রিটিশের শাসন চলে আরও ২০০ বছর। এরপর আবার মুসলিম জাতিসত্তার পাকিস্তান। সেই থেকে একটি নিয়ত স্থিতি পেয়েছে এই রাজধানী ঢাকা। এই পর্বের একেবারে শুরুর কাল থেকে ঢাকার আবাসন আর উন্নয়নের গতি-ত্বরণের সঙ্গে মিশে আছে জহুরুল ইসলামের ইতিবৃত্ত। জহুরুল ইসলামের সৃজনী পদক্ষেপ।
গ্রাম থেকে নগর। আবার নগর থেকে রাজধানী হয়ে ওঠার এই ইতিহাস অজানাকালের আবাসন সংস্কৃতির ঐতিহ্য ধারণ করে আছে। এই ইতিহাস, ঐতিহ্যকে একটি গবেষণা কাঠামোতে ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে উপলব্ধিগত ধারণা আমরা পেতে পারি। এই গবেষণার প্রাসঙ্গিক আলোচনায় জহুরুল ইসলামের কর্মময় জীবন আর রাজধানী ঢাকার আজ পর্যন্ত টিকে থাকা বড় বড় প্রশাসনিক অট্টালিকা ও আবাসন প্রকল্প বিনির্মাণের স্মৃতি কেন্দ্রীভূত হয়।
এই সমৃদ্ধ রাজধানী ঢাকা আজ ঘনবসতিপূর্ণ। বলা চলে ধারণক্ষমতার বেশি মানুষের চাপে যেন ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে। অপরিকল্পিত নির্মাণ, উন্নয়নের অপরিণামদর্শিতা, নির্মাণ ধারায় খামখেয়ালি মিশেল আর অনিয়মিত নির্মাণ প্রকল্প ঢাকাকে করেছে এক এলোমেলো নগরবসতির চরম দুর্দশা। এখানে আবাসন সংকট চরমে উঠেছে। রাস্তাঘাট, পয়োপ্রণালি সবকিছুতেই রয়েছে জটবদ্ধতা। তাই ঢাকাকে নিয়ে বিজ্ঞ-অবিজ্ঞ সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে প্রতিনিয়ত ভাবছেন। সবচেয়ে গরিব থেকে সবচেয়ে ধনী, সবচেয়ে শিক্ষিত থেকে সবচেয়ে অশিক্ষিত সবাই ভাবছেন। কেউ কটাক্ষ করছেন। কেউবা কৌতুক বানাচ্ছেন। কেউ হতাশ হচ্ছেন। কেউ আশু সমাধানের উপায় বের করার কাজে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। সমাধান কিন্তু পরাহত। এ পরিস্থিতিতে ঢাকার নির্মাণ ও আবাসনের বিবর্তনিক ইতিহাস খানিকটা চাহর হওয়া দরকার। কেননা ঢাকাকে কেবল ক্লিষ্টতার মাঝে চিন্তা করলেই চলে না। বরং এই ঢাকার ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে রয়েছে বিশালতা। রয়েছে ধারাক্রম এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সমৃদ্ধি। এই সমৃদ্ধির মধ্যে সবচেয়ে আগে চোখে পড়ে এবং প্রাথমিক চাহিদা মেটায় তার অবকাঠামো। অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নের এই প্রাসঙ্গিক আলোচনায় তাই জহুরুল ইসলামের প্রাসঙ্গিকতা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। জহুরুল ইসলাম এই ঢাকার গৃহায়ন, আবাসন ও নির্মাণ কল্পে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। এ গবেষণায় তার সত্যতা যেমন মিলেছে, তেমন আবাসনশিল্পের মতো একটি সমৃদ্ধ শিল্প খাতও আজকের ঢাকায় বুলন্দ হয়েছে। বলা চলে বেসরকারিভাবে এই আবাসন শিল্প খাত ঢাকার গৃহায়নকে অনেক বেশি সহজ করে তুলেছে এবং ঢাকার উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গতি এনেছে।
পল্লবীর ইস্টার্ন হাউজিং দিয়ে শুরু। এরপর এই ঢাকার নগরায়নের প্রায় ৪০ ভাগ অবদান রাখতে জহুরুল ইসলাম সক্ষম হয়েছেন। প্লট, ফ্ল্যাট, মার্কেটসহ আরও কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যা এই ঢাকার চাপ নিরসনে সহায়ক হয়েছে। জহুরুল ইসলামের জীবনে সেই কীর্তিকর্মের সংগ্রাম আর সমৃদ্ধির মাঝে রয়েছে আজকের তরুণদের উৎসাহ ও শিক্ষা। একজন সফল ব্যবসায় উদ্যোক্তা হতে গেলে বাধা মাড়ানোর কৌশল, দূরদৃষ্টি আর সৃজনশীলতার ব্যবহার কতটা জরুরি তা জহুরুল ইসলামের জীবনীতে শিক্ষণীয় অধ্যায় হয়ে রয়েছে। আগামীর ঢাকায় অতিরিক্ত চাপ মোকাবেলায় ঢাকা নগরীর বিবর্তনিক ইতিহাস-ঐতিহ্যও বিশ্লেষণের দারি রাখে। এই সমূহ ব্যাপার সামনে রেখে এ গবেষণা কাজ এগিয়েছে।
সময়, অবকাঠামো আর তথ্যপ্রাপ্তির বন্ধুরতায় গবেষণায় কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে যায়। জহুরুল ইসলামের জীবনের নানা ঘটনাপ্রবাহের উপাত্ত প্রাপ্তিকে কেন্দ্র করে এই গবেষণায় একইভাবে নানা সীমাবদ্ধতা পাড়ি দিতে হয়েছে। বন্ধুরতা পাড়ি দিয়ে যতটুকু উপাত্ত পাওয়া সম্ভব হয়েছে, তার ভিত্তিতে এই গবেষণাগ্রন্থটি লিখিত হলো। তবে এ গবেষণাটি আরও কিছু প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে, যা বাড়ন্ত গবেষণার দোয়ার খুলে দেয়। ফলে পরবর্তী গবেষণা দাবি রাখে।
জহুরুল ইসলামের জীবন বিশ্লেষণে তার নিজ গ্রামের বাড়ি বাজিতপুরের ভাগলপুরে জাতিতাত্ত্বিক অনুসন্ধান কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। তার সঙ্গে কাজ করেছে এমন লোকদের সঙ্গেও কথা বলা হয়েছে। জহুরুল ইসলামের রেখে যাওয়া স্মৃতি, কর্ম, কীর্তিও মাঠ পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। অংশগ্রহণমূলক সাক্ষাৎকারে ব্যক্তি ও সামষ্টিক পর্যায়ের প্রয়োজনীয়তা মেটানো হয়েছে এ গবেষণার মাঠকর্মে।
রাজধানী ঢাকার বিবর্তনিক ইতিহাসের উপাত্ত খোঁজ করা হয়েছে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি গ্রন্থ ও জার্নাল থেকে। ঢাকার রাজনৈতিক ইতিহাসের গদ ব্যবহার হয়েছে সামান্য। কেননা এখানে ঢাকার আবাসন ও নির্মাণ খাতের গবেষণায় যতটুকু উপাত্তের প্রয়োজন হয় তারই ব্যবহার হয়েছে মাত্র। বর্তমান ঢাকায় জহুরুল ইসলামের অবদান এখনও চোখের সামনে স্পষ্ট। তিনি বিদায় নিয়েছেন কিন্তু তার কীর্তি যেন এখনও যৌবনেই রয়ে গেছে। এসব কীর্তিকর্ম থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। গবেষণায় উপাত্ত বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন লিখনে বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ ও বর্ণনামূলক পদ্ধতিতত্ত্ব ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রশ্ন এসেছে জহুরুল ইসলাম ঢাকার আবাসন সংকট নিরসনে কতটুকু অবদান রাখতে পেরেছেন? তিনি যে অবদান রেখেছেন, তা কি ঢাকাকে সত্যিকার অর্থে উপকৃত করেছে? কেননা, সমূহ উন্নয়নের পরেও ঢাকাবাসী আজও সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তবে কি জহুরুল ইসলাম বা তার মতো অন্যান্য উদ্যোক্তার এসব গৃহায়ন উদ্যোগে ত্রুটি ছিল? নাকি উদ্যোগগুলো কেবল বাণিজ্যিক প্রয়োজনে সমাধা হয়েছেÑতাতে কি রাজউকের কোনো পরিকল্পিত নিয়ন্ত্রণ ছিল না? অথবা আবাসন শিল্প কি বেসরকারি বাণিজ্যিকীকরণে জনদুর্ভোগ বাড়িয়ে তুলেছে? এসব উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব যাই হোক না কেন, সে সময়ের উদ্যোগে নির্মাণ হয়েছে এটা মানতেই হবে। তবে উন্নয়নের মাঝে কিছু পরিকল্পনাহীনতার দরুন সংকট তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে করণীয় কী হতে পারে? এ গবেষণায় সৃষ্ট এসব প্রশ্ন বাড়ন্ত আরও কিছু গবেষণার দাবি রাখে।
এসব প্রশ্ন ১৯৯৫ সালে জহুরুল ইসলামের মৃত্যুর ২৩ বছর পরে আজ চাহর হচ্ছে। কিন্তু তার জীবনকালে ঢাকায় যা নির্মাণ হয়েছিল তা এতটা ভয়ানক জনদুর্ভোগের পরিস্থিতি বলে মনে হয়নি। সেই প্রেক্ষাপটে জহুরুল ইসলামকে মাপলে আরও পেছনে ১৯৪৭ থেকে ১৯৯৫ সালের নির্মাণ বিশ্লেষণ করা জরুরি হয়ে পড়ে।
আসলে নতুন সৃষ্টি একটি রাষ্ট্র পাকিস্তান ছিল এদেশের আপামর জনতার স্বপ্নের রাষ্ট্র। ব্রিটিশের শোষণমুক্তির পরে জীর্ণ আর শূন্যদশা থেকে বেরিয়ে আসতে সরকার যেমন ছিল উদ্যোগী, তেমনি বেসরকারি পাটাতন থেকে জহুরুল ইসলাম ও তার মতো কিছু উদ্যোক্তার কর্ম ছিল সহায়ক। জহুরুল ইসলাম দেশি-বিদেশি বিভিন্ন অভিজ্ঞতার আলোকে দেশের গৃহায়ন ও নির্মাণ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপচারিতার মাধ্যমে এই সাহসী ও সৃজনী পদক্ষেপ নিতে পেরেছিলেন। তাছাড়া একজন ব্যবসায় উদ্যোক্তা কখনোই তার অর্জিত অর্থ অলস ফেলে রাখবেন না, সেই অর্থ কোথাও না কোথাও লগ্নি করবেনÑসেটাই স্বাভাবিক। এটা আধুনিক অর্থনীতির ধারণাতেও সিদ্ধ। একইভাবে জহুরুল ইসলাম তার ঠিকাদারি কাজে আহরিত বিপুল অর্থ দিয়ে স্বল্প মূল্যে জমি কিনেছিলেন। সেই জমি তিনি বিক্রি করে প্রচুর অর্থ কামিয়েছিলেন। এটা তার পুঁজি গঠনেও সহায়ক ছিল। আবার পরবর্তী সময়ে সেই জমিতে আবাসনশিল্প গড়ে তুলে নিজের বাণিজ্যিক উদ্যোগের সফলতা যেমন পেয়েছেন, ঢাকার নগরায়নেও প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। এভাবেই এই আধুনিক ঢাকার আবাসন আর নির্মাণশিল্পের সঙ্গে জহুরুল ইসলাম মিশে আছেন।
লেখক: গবেষক, শেয়ার বিজ।