রোহান রাজিব: বেসরকারি খাতের যমুনা ব্যাংকের দিলকুশা শাখার এডি লাইসেন্স স্থগিত থাকাকালে অবৈধভাবে বৈদেশিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। যদিও এ অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্য বড় ধরনের শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি যমুনা ব্যাংককে। কারণ ওই সময়ে যমুনা ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন সাবেক গভর্নর ফজলে কবিরের ছোট ভাই সালেহ কবির।
গভর্নরের ভাইয়ের সুবিধা নিয়েই এ কাণ্ড করেছে যমুনা ব্যাংক। এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন সালেহ কবির নিজেও। বাংলাদেশ ব্যাংক জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিতে বললেও সালেহ কবিরের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়নি যমুনা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
জানা যায়, ২০১২ সালে ‘ভুয়া’ রপ্তানি বিলের বিপরীতে যমুনা ব্যাংকের দিলকুশা শাখা থেকে গ্রাহক ও কর্মকর্তার যোগসাজশে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়। এ ঘটনা প্রমাণিত হলে ২০১৯ সালের ৭ আগস্ট ওই শাখার এডি লাইসেন্স এক বছরের জন্য স্থগিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর তাদের সীমিত পরিসরে বৈদেশিক বাণিজ্যিক লেনদেনের সুযোগ দেয়া হয়।
আবার কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ পেয়ে ২০২০ সালের ৬ আগস্ট পর্যন্ত ৫৯৯টি ইএক্সপি ও ১৩১টি ঋণপত্র খুলে যমুনা ব্যাংকের দিলকুশা শাখা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের নির্দেশনা অমান্য করে ১৩৮টি রপ্তানি ফরম (ইএক্সপি) ও ২৮টি ব্যাক টু ব্যাংক এলসি খুলে যমুনা ব্যাংকের দিলকুশা শাখা, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট এবং ব্যাংক কোম্পানি আইনেও এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সূত্রে জানা যায়, দিলকুশা শাখার এডি লাইসেন্স স্থগিত থাকা অবস্থায় বৈদেশিক লেনদেনের সঙ্গে যমুনা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল ডিভিশন (আইডি), ব্যাংকিং/ব্রাঞ্চ অপারেশন্স ডিভিশন (বিওডি) ও ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স ডিভিশন (আইসিসি) জড়িত ছিল। আর এ সময়ে ব্যাংকিং/ব্রাঞ্চ অপারেশন্স ডিভিশনের (বিওডি) হেড ছিলেন সাবেক গভর্নর ফজলে কবিরের ছোট ভাই সালেহ কবির। তার যোগসাজশে এসব কার্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়। তাকে বাঁচাতে ও যমুনা ব্যাংককে সুবিধা দিতে এমন গুরুতর অপরাধের জন্য কোনো বড় ধরনের শাস্তি দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবির। আবার যখন এডি লাইসেন্স স্থগিত করার সিদ্ধান্ত হয়, সেটাও কার্যকর করা হয়নি।
জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক যমুনা ব্যাংকের বিরুদ্ধে বড় ধরনের শাস্তি না দিয়ে বৈদেশিক বাণিজ্যিক ঝুঁকি কমাতে ও ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলার জন্য ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীকে কঠোরভাবে সতর্ক ও চেয়ারম্যানকে অভিহিত করার জন্য বলা হয়। এছাড়া সংশ্লিষ্ট তিন বিভাগের প্রধান এবং এর সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য যমুনা ব্যাংককে নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এতে দেখা যায়, জড়িতদের মধ্যে তিনজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় যমুনা ব্যাংক। সবার এক বছরের জন্য বার্ষিক ইনক্রিমেট স্থগিত করা হয়। তবে ব্যাংকিং/ব্রাঞ্চ অপারেশন্স ডিভিশনের (বিওডি) হেড সালেহ কবিরের বিরুদ্ধে কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার প্রমাণ মেলেনি। এছাড়া এমন কর্মকাণ্ড ঘটনার জন্য যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীর অদক্ষতা ও দুর্বলাতাকে দায়ী করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মির্জা ইলিয়াছ উদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের সমাধান হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড না ঘটে, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্ক করে দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, তিনজনকেই শাস্তি দিয়েছি। তবে সাবেক গভর্নরের ভাইয়ের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে এ বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। এছাড়া নির্দেশনা অমান্য করে এ কার্যক্রম চালিয়েছে, এমন প্রশ্নেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এত বড় অপরাধের জন্য যমুনা ব্যাংকের দিলকুশা শাখার এডি লাইসেন্স আবার বন্ধ করা উচিত ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। একইসঙ্গে জরিমানা আরোপ করে তাদের কঠোরভাবে সতর্ক করা উচিত ছিল।
উল্লেখ্য, এর আগে ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিসমিল্লাহ টাওয়েলস লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আলফা কম্পোজিট টাওয়েলস লিমিটেড ও শেহরিন টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের অনুকূলে ভুয়া রপ্তানি বিলের বিপরীতে ফরেন ডকুমেন্টারি বিল পারচেজ (এফডিবিপি) খাতে অর্থায়নের মাধ্যমে গ্রাহক ও ব্যাংকের কর্মকর্তার যোগসাজশে প্রতারণা ও জালজালিয়াতির মাধ্যমে যমুনা ব্যাংকের দিলকুশা শাখা থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়। সেই অপরাধ প্রমাণিত হলে ২০১৯ সালে এক বছরের জন্য যমুনা ব্যাংকের দিলকুশা শাখার এডি লাইসেন্স বাতিল করা হয়।