গমনকারীদের থেকে কর আদায়ে প্রস্তাব হাইকমিশনের

রহমত রহমান: প্রতি বছর লাখ লাখ রোগী চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাচ্ছেন। ভারত ছাড়াও থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিতে লাখ লাখ বাংলাদেশি যাচ্ছেন। দিন দিন এ সংখ্যা বেড়েই চলছে। দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থায় আস্থাহীনতা আর ভোগান্তির কারণে বাংলাদেশিদের বিদেশমুখী বিশেষ করে ভারতমুখী বাড়ছে। কখনও চিকিৎসা ভিসা আবার কখনও ট্যুরিস্ট ভিসায় গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন বাংলাদেশিরা। যাতায়াতের সহজ মাধ্যম হওয়ায় ভারতে উচ্চশিক্ষা নিতে যাচ্ছেন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা। আবার পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়ায় ভারতে অহরহ ঘুরতে যাচ্ছেন বাংলাদেশিরা। চিকিৎসা নিতে যাওয়া, ঘুরতে যাওয়াদের মধ্যে অধিকাংশই বিপুল অর্থ দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে জটিল রোগের চিকিৎসা করাতে ১০ থেকে ২০ লাখ বা কোটি রুপি নিয়ে যাচ্ছেন। দুই দেশের মধ্যে এই অর্থ বিনিময়ের বৈধ পন্থা না থাকলেও হুন্ডি বা অবৈধ পথে এই অর্থ অনেকেই নিয়ে যাচ্ছেন।

আবার অনেক শিক্ষার্থী বছরে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা দেশ থেকে নিচ্ছেন। বৈধ পথে এই অর্থ নেয়ার সুযোগ কম থাকায় অবৈধভাবে নিচ্ছেন। এর ফলে একদিকে যেমন দেশ থেকে ডলার বা মুদ্রা চলে যাচ্ছে, অন্যদিকে করযোগ্য ব্যক্তিরা করফাঁকি দিচ্ছেন। ভারতে চিকিৎসা নেয়া বা ঘুরতে যাওয়া বাংলাদেশিদের বেশিরভাগের করযোগ্য আয় রয়েছে। আবার যেসব শিক্ষার্থী ভারতে লেখাপড়া করতে যান, তাদের অভিভাবকদের করযোগ্য আয় রয়েছে। চিকিৎসা, ভ্রমণ ও শিক্ষা নিতে যাওয়াদের অধিকাংশের আয় করযোগ্য বলে মনে করে ভারতের নয়া দিল্লিতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন। এর ফলে একদিকে সরকারের আয় বাড়বে, অন্যদিকে অবৈধভাবে দেশ থেকে অর্থ যাওয়া রোধ ও বৈদেশিক মুদ্রার (ডলার) সাশ্রয় হবে বলে মনে করে হাইকমিশন। এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার প্রস্তাব দিয়ে হাইকমিশন থেকে পররাষ্ট্র সচিবকে এ-সংক্রান্ত চিঠি দেয়া হয়েছে। হাইকমিশনার মোহাম্মদ ইমরান সই করা এই চিঠি দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সেই চিঠি সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যানকে দেয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যোগাযোগের গভীরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় নানা কারণে জনগণের যাতায়াত বেড়েছে। বর্তমানে ভারতে আগমনকারী বিদেশির প্রতি পাঁচজনের একজন বাংলাদেশ থেকে আসেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যমান আর্থিক নীতিমালার সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করলে একটি বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হতে পারে। বিবেচনার জন্য চিঠিতে পাঁচটি প্রস্তাবনা দেয়া হয়। এর মধ্যে প্রথম হলো চিকিৎসা। চিকিৎসা বিষয়ে চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ চিকিৎসা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উৎকর্ষ লাভ করায় দেশের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোয় বিপুলসংখ্যক ভারতীয় শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন। এর পরও প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি মস্তিষ্ক, হƒদযন্ত্র, যকৃৎ ও বুক-সংক্রান্ত প্রাণঘাতী রোগ এবং অঙ্গ প্রতিস্থাপন, ক্যানসার, বন্ধ্যাত্ব জাতীয় বিশেষ ধরনের জটিল রোগের চিকিৎসা করাতে আসেন। এ ছাড়া সাধারণ রোগের চিকিৎসার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি ভারতে আসেন। প্রায়ই একজন রোগীর সঙ্গে কয়েকজন সহযোগী এসে থাকেন; যা খরচের পরিমাণকে বৃদ্ধি করে। এদের অনেকেই চিকিৎসা নিতে এসে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে বিপুল অঙ্কের চিকিৎসা খরচের অভিযোগ অথবা প্রতারণার শিকার হয়ে দূতাবাসের শরণাপন্ন হন। দূতাবাসকে সে ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে হয়। চিকিৎসার মান নিয়েও অনেকে অভিযোগ করে থাকেন। অথচ দেখা যাচ্ছে, জটিল ও মুমূর্ষ রোগী ছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরনের চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে করা সম্ভব। তাই বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের বিদেশি চিকিৎসা নেয়ার প্রয়োজন আছে কি নাÑসে বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও অনুমতি প্রদানের জন্য উপজেলা, জেলা বা জাতীয় পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি বা বিশেষ ব্যবস্থার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হতে পারে।

আরও বলা হয়, বিভিন্ন জটিল রোগ ও অঙ্গ প্রতিস্থাপন, ক্যানসার, বন্ধ্যাত্ব জাতীয় চিকিৎসার ক্ষেত্রবিশেষে ১০-২০ লাখ থেকে শুরু করে এক কোটি রুপি পর্যন্ত খরচ হয়ে থাকে। উভয় দেশের মধ্যে এই অর্থ বিনিময়ের কোনো বৈধ ব্যবস্থা না থাকায় চিকিৎসা নিতে আসা বাংলাদেশিদের বড় একটি অংশ হুন্ডি বা অন্য কোনো অবৈধ উপায়ে অর্থ স্থানান্তর করে থাকে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতের মেডিকেল ট্যুরিজম খাতে আয় প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ভারতে আসা মেডিকেল ট্যুরিস্টদের ৫৭ দশমিক ৫ শতাংশ বাংলাদেশ থেকে আসে। এ পরিসংখ্যান থেকে বাংলাদেশিদের চিকিৎসা খরচের কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। চলতি অর্থবছর বাজেটে বেশ কিছু সেবার ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণক দেখানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যারা চিকিৎসা নিতে বিদেশে আসেন, তাদের বার্ষিক ন্যূনতম আয় আয়করযোগ্য হওয়াটাই স্বাভাবিক। চিকিৎসা-সংক্রান্ত ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভ্রমণের কোনো এক পর্যায়ে বাধ্যতামূলকভাবে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণক প্রদর্শনের বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে তা সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে আসা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্রছাত্রী ভারতের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ খরচে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশোনা করছেন। প্রতি বছর এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে। স্নাতক পর্যায়ের একজন শিক্ষার্থীকে ভারতে প্রতি বছর আনুমানিক তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। এক্ষেত্রে বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকে নিরুৎসাহিত না করে, ছাত্রছাত্রীরা যাতে সঠিক ও বৈধ চ্যানেলে অর্থ স্থানান্তর করে তা নিশ্চিত করা যেতে পারে। অভিভাবকদের রিটার্ন দাখিলের প্রমাণক থাকা প্রয়োজন। পার্শ্ববর্তী পশ্চিম বাংলা ছাড়াও সুদূর কাশ্মীর থেকে মধ্য ভারত বা দক্ষিণ ভারত, এমনকি উত্তর-পূর্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বর্তমানে বাংলাদেশি পর্যটকদের পদচারণা রয়েছে। ভারতের বিভিন্ন ঐতিহাসিক বা ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও বিখ্যাত স্থাপত্য বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এলাকায় বাংলাদেশির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পর্যটকদের এ সংখ্যা ক্রমান্বয়েই বাড়ছে। এক্ষেত্রেও বিদেশ ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশি পর্যটকরা যাতে সঠিক ও বৈধ পথে অর্থ নিয়ে আসে, তা নিশ্চিত করা যেতে পারে। ধর্মীয় উৎসব, বিয়ে বা অন্য কোনো সামাজিক উৎসব উপলক্ষে কেনাকাটার জন্য বছরজুড়েই বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি ভারতে ভ্রমণ করে থাকেন। বৈধ পথে অর্থ আনার বিষয়টির পাশাপাশি সরকারি ব্যাগেজ রুল যাতে যথাযথভাবে প্রতিপালন করা হয়, তা নিশ্চিত করা যেতে পারে।

আরও বলা হয়, ভিসা বা অন্যান্য দলিলাদি থেকে প্রতীয়মান হয়, বর্তমানে ভারতের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাগরিক বাংলাদেশে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত। উদার ভিসা নীতিমালার সুযোগ গ্রহণ করে পর্যটক ভিসায় এসে অনেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্প, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে পেশাজীবীদের সঠিক নিয়ম অনুসরণপূর্বক ই-ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে বাংলাদেশে কাজে যোগদানের বিষয়টি নিশ্চিত করা যেতে পারে। একইসঙ্গে বাংলাদেশে কর্মরত এসব বিদেশি নাগরিক যথাযথভাবে আয়কর প্রদান করছেন কিনা এবং বৈদেশিক মুদ্রা-সংক্রান্ত নীতিমালা পালন করে বৈধ পথে তাদের উপার্জিত অর্থ স্বদেশে নিচ্ছেন কি নাÑসেই বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে।

বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস ফোরামের (বিওটিওএফ) তথ্যমতে, প্রতি বছর গড়ে আট লাখ মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নিতে যায়। এর বড় অংশই যায় ভারতে। বেশিরভাগ মানুষ ট্যুরিস্ট ভিসায় গিয়ে চিকিৎসা নেন। এ বিষয়ে আগামী বাজেটে কাজ করা হবে বলে এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০