নাজমুল হুসাইন: দুই সপ্তাহ আগে খোলাবাজারে যে ময়দার বস্তা (৫০ কেজি) এক হাজার ৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, গতকাল তার দাম ছিল এক হাজার ৯০০ টাকা। সে হিসাবে কেজিপ্রতি ময়দার দাম ১০ টাকার বেশি বেড়েছে। শুধু খোলা ময়দা নয়, দেশের প্রায় সব কোম্পানির প্যাকেটজাত ময়দার দামও বেড়েছে। কেজিপ্রতি চার টাকা হারে এখন প্রচলিত দুই কেজি ময়দা কিনতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে বাড়তি আট টাকা। ময়দা উৎপাদনকারী সব কোম্পানির কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হঠাৎ অস্থির হয়ে পড়েছে এর বাজার।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত দুই-তিন দিন বাজারে মিল থেকে কোনো ময়দা সরবরাহ হয়নি। পণ্য সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো তাদের কারখানা বন্ধ রেখেছে। এতে বর্তমানে বাজারে মজুদ ময়দা কেনাবেচা হচ্ছে। ফলে বিক্রি হচ্ছে ব্যবসায়ীদের মনমতো দামে। এর প্রভাবে বাজারে ময়দার দাম অস্থিতিশীল হয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তবে আটার দামে তেমন কোনো হেরফের হয়নি।
এদিকে বাজারের এ পরিস্থিতি কারণ হিসেবে কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, ময়দা তৈরিতে ব্যবহৃত উন্নতমানের কানাডার গমের প্রচণ্ড সংকট চলছে। বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম হঠাৎ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে বর্তমানে ময়দা উৎপাদনে লোকসান হচ্ছে। এছাড়া বেশ কয়েকটি কোম্পানির হাতে একেবারেই প্রয়োজনীয় ময়দার গম নেই। সেসব কোম্পানি ময়দা উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। দু-একটি মিল চালু থাকলেও তারা সরবরাহ একেবারেই কমিয়ে দিয়েছে।
এ বিষয়ে এসিআই ফুডসের বিজনেস ডিরেক্টর অনুপ কুমার সাহা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘হঠাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন কানাডিয়ান গম ২২০ ডলার থেকে বেড়ে ২৮০ ডলার হয়েছে।
এছাড়া পর্যাপ্ত গমও আমাদের হাতে নেই। দেশের খোলাবাজারেও গমের দাম মণে প্রায় ৫০০ টাকা বেড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘তবে আমাদের মিল বন্ধ নেই। কিন্তু প্রয়োজনীয় গমের মজুদ না থাকায় সরবরাহ লিমিটেড করা হয়েছে। গমের সংকট না কাটলে এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।’
পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কয়েক সপ্তাহ থেকেই বাজারে ময়দার সরবরাহ কম। তবে দুই সপ্তাহ আগে বসুন্ধরা, আকিজ, টিকে গ্রুপের মতো বেশ কিছু কোম্পানি খোলা ময়দার সরবরাহ বন্ধ করে। শেষ দুই-তিন ব্যবধানে ময়দার সর্ববৃহৎ সরবরাহকারী সিটি গ্রুপেরও মিল বন্ধ হয়। এতে মিল থেকে কোনো ময়দা সরবরাহ করা হচ্ছে না। এরপর বাজারে বাকি ছোট অন্য দু-একটি মিলে ময়দা বিক্রি হলেও, এখন সেটাও পাওয়া যাচ্ছে না।
মৌলভীবাজারের মা ট্রেডিং করপোরেশনের কার্তিক নন্দী বলেন, ‘বর্তমান পাইকারি বাজার ও বিভিন্ন গুদামে মজুদ থাকা ময়দা কেনাবেচা হচ্ছে। সব ব্যবসায়ীর কাছে প্রচুর ডিও রয়েছে। কিন্তু মিল থেকে কোনো ময়দা দেওয়া হচ্ছে না।’
মৌলভীবাজারে গতকাল বিভিন্ন গ্রুপ কোম্পানিগুলোর প্রতি বস্তা ময়দা কেনাবেচা হয়েছে এক হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত। সরবরাহ না থাকায় অনেকটা মনমতো দামেই মজুদকারীরা পণ্যটি বিক্রি করছেন। ফলে বাজার ঘুরে ময়দার দাম কোথাও এক হাজার ৭০০ টাকা আবার পাশেই এক হাজার ৮০০ টাকায় দেখা গেল। কারওয়ান বাজারে এসে এ আটা ১ হাজার ৯০০ টাকা, যা দুই সপ্তাহ আগে ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৩৫০ টাকায় বিক্রি হতো।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি আটা-ময়দার ব্যবসায়ী আবুল হোসেন বলেন, ‘ডিও কেটে বসে আছি। কোনো মিল ময়দা দেয়নি। তাই গতকাল মৌলভীবাজার থেকে সব ব্যবসায়ী মিলে পাইকারি এক ট্রাক ময়দা এনেছি। এখন বাজারে অরাজকতা চলছে; যে যা পারে সেই দামে বিক্রি করছে।’
এদিকে খুচরা বাজারেও এ অবস্থার প্রভাব পড়েছে। খুচরা পর্যায়ে প্যাকেটজাত ময়দার দাম বাড়ানো হয়েছে কেজিপ্রতি ৪ টাকা। খোলা ময়দা বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা বাড়তি দামে। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ময়দা আগে ৩০-৩২ টাকা বিক্রি হলেও এখন তা ৪০-৪২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে ময়দার এ পরিস্থিতিতে আটার বাজারে
তেমন দামের কোনো হেরফের হয়নি। বাড়তি চাহিদায় কিছু দোকানে দু-এক টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে আটা।
গমের পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে প্রমাণ মেলে সংকটের তথ্য। রাজধানীসহ দেশের বাজারে এক সপ্তাহের ব্যবধানে উন্নত মানের কানাডিয়ান গমের দাম বেড়েছে মণপ্রতি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। এক সপ্তাহ আগে প্রতি মণ (৩৭ কেজি) উন্নত মানের কানাডিয়ান গম (মাছি গম নামে প্রচলিত) দাম ছিল ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা; যা বর্তমানে ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এ অবস্থায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের চাহিদার ৮০ শতাংশ গমই আমদানি করে মেটানো হচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর দেশে গমের দাম পুরোটাই নির্ভরশীল। এ অবস্থায় আমদানিকৃত গমের উচ্চ মূল্য দেশীয় বাজারেও ময়দা দিয়ে উৎপাদিত পণ্যের দামে প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে উন্নতমানের পাউরুটি, বিস্কুটসহ ফাস্টফুডের অধিকাংশ তৈরি হয় ভালো ময়দা থেকে।