গম উৎপাদনে সংকট বাড়াচ্ছে স্বল্পমেয়াদি শীত ও ‘ব্লাস্ট’

নাজমুল হুসাইন: গত বছর দেশে দেখা দেয় গমের ‘ব্লাস্ট’ রোগ। এ কারণে চলতি মৌসুমে আট জেলায় ৯০ শতাংশ জমিতে গমের আবাদ হয়নি। অন্যদিকে যেসব এলাকায় গমের চাষ হয়েছে, সেখানেও পর্যাপ্ত শীত নেই, তাপমাত্রা বেশি। এতে কাক্সিক্ষত ফলন না পাওয়ার আশঙ্কায় সাধারণ কৃষকরা গমচাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। সুতরাং কমে গেছে শস্যটির উৎপাদন। এ অবস্থায় চলতি মৌসুমে গম আবাদে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। ফলে দ্বিতীয় প্রধান এই খাদ্যশস্যের উৎপাদন নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে।

চলতি মৌসুমে দেশে গম আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৬২ হাজার হেক্টর জমিতে। এর বিপরীতে গমের আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে, যা গত অর্থবছর থেকে কম। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে গমের আবাদ হয়েছিল ৪ লাখ ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে। তাই গতবারের তুলনায় এবার অন্তত ৮০ হাজার টন কম গম উৎপাদন হবে। তবে আগের তুলনায় অনেক কম এখন গমের উৎপাদন, যা গত তিন-চার বছর একই ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে গমের উৎপাদন হয়েছে ১৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৮৬ টন, যা আগের অর্থবছর থেকে মাত্র ২৬০ টন বেশি। ওই বছর উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৪৭ হাজার ৯২৬ টন। প্রসঙ্গত নব্বই দশকের শেষ পর্যন্ত দেশে গমের উৎপাদন ছিল প্রায় ১৮ লাখ টন। এরপর থেকে ক্রমেই গমের উৎপাদন কমছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই কারণে গমের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না, যা এখন বড় শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমত স্বল্পমেয়াদি শীত। কম শীত হওয়ায় গড় তাপমাত্রা বেড়েছে; কিন্তু গমচাষে দীর্ঘমেয়াদি শীত প্রয়োজন। অন্যদিকে, গত বছরের ব্লাস্ট রোগ, যা ফলন বিপর্যয় ঘটিয়ে এ বছরও আবাদ কমাচ্ছে।

কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সাধারণত গমের বপনকাল নভেম্বরে। এরপর বীজ অঙ্কুরোদগমে সময় উপযোগী তাপমাত্রা হলো ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গমের পরাগায়নের সময় তাপমাত্র প্রয়োজন ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। এর কমবেশি হলে গমের উৎপাদন কমে যায়। কিন্তু শীত স্বল্পমেয়াদি হওয়ায় সব এলাকায় এখন তাপমাত্রা অনুকূলে থাকছে না।

জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক কৃষিবিদ চৈতন্য কুমার দাস বলেন, ‘মূলত স্বল্পমেয়াদি শীতই সারা দেশে গম উৎপাদন না বাড়ার প্রধান কারণ। গমের জন্য শীত প্রয়োজন। অধিক তাপমাত্রা হলেও গমের ভালো ফলন হয় না। কিন্তু গত কয়েক বছর ক্রমেই শীত কমেছে। ফলে গমের আবাদ থমকে রয়েছে।’

আবহাওয়া অধিদফতরের পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে। ২০০৫ সালের ২৮ জানুয়ারি বাংলাদেশের সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা ছিল ১৩ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা বেড়ে ২০১৫ সালে ১৫ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এসে দাঁড়ায়। আর এ বছর একই দিনে গড় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল ১৬ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

অন্যদিকে এ বছরও মেহেরপুরে গমক্ষেত ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ডিএই’র সরেজমিন উইং থেকে বলা হয়েছে, ৪ হেক্টর জমির গম ব্লাস্ট রোগের কারণে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বৃষ্টি, কুয়াশা ও আর্দ্রতা বাড়লে ব্লাস্ট রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে। কিন্তু ডিএই’র পক্ষ থেকে গম আবাদকে নিরুৎসাহিত করা হলেও নিষিদ্ধ করা হয়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. তোফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে একটি গবেষকদল ব্লাস্ট রোগ নিয়ে গবেষণা করছেন। এ রোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘নতুন রোগপ্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন ছাড়া এ রোগ নির্মূল করা সম্ভব নয়। আক্রান্ত গমক্ষেত পুড়িয়ে বা কেটে গবাদিপশুর খাবার হিসেবে ব্যবহার করে এ রোগের সংক্রমণ রোধ করা যাবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়া সাময়িকভাবে গমচাষ বন্ধ করাও কোনো কার্যকর সমাধান নয়। গমের ব্লাস্ট নামক সর্বগ্রাসী ছত্রাকের জন্য অনুকূল আবহাওয়া হচ্ছে ১৮ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা, গাছের ফুল আসার সময় এই তাপমাত্রা ব্লাস্ট আক্রমণের কারণ হতে পারে।’

তিনি জানান, এছাড়া বৃষ্টি ও কুয়াশায় গাছের পাতা ১০ ঘণ্টার বেশি সময় ভেজা থাকলে এর প্রকোপ ভয়াবহভাবে বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে জলবায়ুর পরিবর্তন ব্লাস্ট রোগের জন্য বড় কারণ।

 

 

 

Add Comment

Click here to post a comment

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০