তৌফিক সুলতান : গরমকালে নানারকম ফলফলাদির মিললেও অতিরিক্ত গরম হয় অশান্তির প্রধান কারণ অসুখ বিসুখের মাধ্যম। সচেতনতা ও যত্নবান হলে কিছুটা স্বস্তি মিলবে। গরমের সঙ্গে জনজীবনে বাড়ছে অস্বস্তি। অস্বস্তিতে ভোগার পাশাপাশি অনেকে অসুস্থও হয়ে পড়ছেন। ডায়রিয়া, বমির মতো সমস্যা লেগেই আছে। তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ঝুঁকি বাড়ছে আরও কিছু অসুখের।
গ্রীষ্মের মৌসুম শুরুর সময় থেকেই ‘হিট ওয়েভ’ সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই তাপপ্রবাহে যেসব রোগের ঝুঁকি বাড়ছে।
হিট সিঙ্কোপ : প্রচণ্ড রোদে বের হলে অনেক সময় মাথা ঘুরে যাওয়া, চোখমুখে অন্ধকার দেখার মতো কিছু শারীরিক সমস্যা হয়। এগুলোকেই ‘হিট সিঙ্কোপ’ বলা হয়। দীর্ঘক্ষণ আগুনের আশপাশে থাকলেও এমন হতে পারে। এমন হলে সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে নেয়া জরুরি। কিংবা বরফ পানি দিয়ে শরীর মুছে নিতে পারলে ভালো। অবশ্যই বেশি করে পানি খেতে হবে। না হলে যেকোনো সময় এমন হতে পারে।
হিট টিটানি : তীব্র তাপপ্রবাহে অনেক সময় হাত-পা বেঁকে যায়। হাত-পায়ের সাড় চলে যায়। হাত আর পা ভাঁজ করতেও বেগ পেতে হয়। এ ধরনের সমস্যাকে ‘হিট টিটানি’ বলা হয়। এমন হলে প্রাথমিকভাবে বিশ্রাম নেয়া জরুরি। সেই সঙ্গে হাত-পা মালিশ করতে পারলে ভালো। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিলে আর পরিমাণ মতো পানি খেলেই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠা যায়।
হিট ক্র্যাম্প: গরমে কায়িক পরিশ্রম বেশি হলে কিংবা দীর্ঘক্ষণ শরীরচর্চা করলে ‘হিট ক্র্যাম্প’ হতে পারে। এমন হলে কাঁধ, ঘাড় ও ঊরুর পেশিতে টান ধরে। বেশি করে পানি খেলে অবশ্য স্বস্তি মেলে। তবে শুধু পানি না খেয়ে স্যালাইন খেলে বেশি উপকার হয়। সেই সঙ্গে বিশ্রাম নিলে আর রোদ এড়িয়ে চললেই টান ধরা কমে যাবে।
হিট স্ট্রোক : গরমের সময়ে সবচেয়ে ঝুঁকি থাকে হিট স্ট্রোক হওয়ার। এই স্ট্রোক হলে শরীর অনেক শুকিয়ে যায়। ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়। শরীরের ভেতরের অংশ গরম হয়ে যায়। কিন্তু হাত-পা ঠাণ্ডা থাকে। হƒৎস্পন্দনের গতি কমে যায়। শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সমস্যা হয়। কারও ক্ষেত্রে খিঁচুনি উঠতে পারে। ভুল বকা কিংবা সাময়িকভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়াও হিট স্ট্রোকের লক্ষণ। এমন হলে রোগীকে ভালো করে গোসল করিয়ে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
হিট পিডিমা: গরমে অনেকের হাত-পা ফুলে যায়। চিকিৎসা পরিভাষায় যাকে ‘হিট পিডিমা’ বলা হয়। অনেকেরই হয় এমন। বিশেষত পা বেশি ফুলে যায়। কখনো আবার হাত ও পা একসঙ্গে ফুলে যায়। এই রোগের বিশেষ কোনো ওষুধ নেই। বিশ্রাম নিলে, বেশি করে পানি খেলে আর উঁচু বালিশের ওপর পা তুলে রাখলে দ্রুত সেরে ওঠা যায়।
জ্বর : শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে বেশি তাপমাত্রাই (৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট) হলো জ্বর। তবে জ্বর কোনো রোগ নয়, শরীরের কোনো অসুস্থতা বা সংক্রমণের লক্ষণ অর্থাৎ রোগের উপসর্গ হলো জ্বর। বিভিন্ন কারণে জ্বর হতে পারে। যেমনÑভাইরাস সংক্রমণজনিত জ্বর-ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া, হাম ও জলবসন্ত। এছাড়া টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, নিউমোনিয়া এবং প্রস্রাবের সংক্রমণ ইত্যাদি কারণেও জ্বর হতে পারে। তবে এ সময়ে সাধারণত ভাইরাস জ্বরের প্রকোপ অত্যধিক বেশি হয়।
ভাইরাস জ্বরের লক্ষণ : হাঁচি, কাশি, নাক দিয়ে পানি পড়া, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, সারা শরীরে ও হাতে-পায়ে ব্যথা অনুভব করা, মাথাব্যথা, খাবারে অরুচি, মুখে বিস্বাদ লাগা; বমি বমি ভাব ও বমি হওয়া, ত্বকে র্যাশ দেখা দেয়া, শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, শীত শীত অনুভূত হওয়া এবং কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা। শিশুদের অতিরিক্ত জ্বরের কারণে কখনো কখনো খিঁচুনি হতে পারে। জ্বর কমানোর জন্য প্রথমে দেহের তাপমাত্রা কমানোর ওষুধ প্যারাসিটামল খাওয়াতে হবে। ভাইরাস জ্বরে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর নয়। শিশুদের বেলায় জ্বর হলে একটু বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
জ্বর হলে প্রাথমিকভাবে কুসুম গরম পানি দিয়ে স্পঞ্জিং করা উচিত। খুব ঠাণ্ডা পানি ব্যবহার করা ঠিক নয়। পুরো শরীর কুসুম গরম পানিতে ভেজানো নরম কাপড় বা তোয়ালে দিয়ে টানা কয়েকবার আলতো করে মুছে দিলে শরীরের তাপমাত্রা কমে যায় এবং খুব ভালো বোধ করে আক্রান্ত রোগী। মাথায় পানি দিতে হবে। রোগীকে ফ্যানের বাতাসের নিচে রাখুন। জ্বর ও ব্যথা কমাতে মাত্রা অনুযায়ী প্যারাসিটামল সিরাপ/ট্যাবলেট খাওয়াতে হবে। উচ্চমাত্রায় জ্বর (১০৩ ফা.) হলে অথবা মুখে খেতে না পারলে মলদ্বারে প্যারাসিটামল সাপোজিটরি ব্যবহার করা প্রয়োজন। খাবার স্যালাইন, ফলের রস, শরবত ইত্যাদি তরল খাবার বেশি বেশি খাওয়াতে হবে। অন্যান্য স্বাভাবিক খাবার স্বাভাবিক নিয়মে চলবে। স্বাভাবিক সব খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খাওয়াতে হবে। তবে তরল খাবার অবশ্যই বেশি বেশি দিতে হবে। টকজাতীয় ফল জাম্বুরা, আমড়া, কমলা, লেবু ইত্যাদি খাওয়া ভালো।
জ্বর তিন দিনের মধ্যে প্রশমিত না হলে বা আনুষঙ্গিক অন্যান্য উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বিশেষ করে শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনি, অতিরিক্ত বমি, পাতলা পায়খানা এবং ত্বকে র্যাশের জন্য দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রয়োজনে নিকটস্থ হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।
ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা: গরমের সময় সাধারণত ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা বেশি হয়। প্রতিদিন কমপক্ষে তিনবার বা এর বেশি অতিরিক্ত পাতলা পায়খানা হলে তাকে ডায়রিয়া বলে। তবে স্বাভাবিক পায়খানা যদি তিনবার বা তার বেশি হয়, তা কিন্তু ডায়রিয়া নয়। যে শিশুরা বুকের দুধ পান করে, তারাও বারবার নরম পায়খানা করে, সেটিও ডায়রিয়া নয়। ডায়রিয়ায় মলের চেয়ে পানির পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। পাতলা পায়খানার সঙ্গে যদি রক্তমিশ্রিত থাকে, তবে সেটি আমাশয়।
ডায়রিয়ার কারণে শরীর থেকে প্রচুর পানি ও খনিজ লবণ বের হয়ে যায়। তখন পানির ঘাটতি বা পানিশূন্যতা দেখা যায়। মনে রাখতে হবে, শিশু যেন পানিশূন্যতায় না ভোগে। তাই ডায়রিয়া হলে তাকে ঘন ঘন স্যালাইন খাওয়াতে হবে। তার প্রস্রাবের পরিমাণ স্বাভাবিক আছে কিনা খেয়াল রাখতে হবে। ছোট শিশুদের কোনো অবস্থায়ই মায়ের দুধ বন্ধ করা যাবে না। ছয় মাসের উপরের শিশুদের ক্ষেত্রে মায়ের দুধের সঙ্গে পানি ও অন্যান্য খাবারও দিতে হবে। একই সঙ্গে তাকে তরল খাবারও দিতে হবে। যতক্ষণ শিশুর পায়খানা স্বাভাবিক না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ নিয়ম মেনে চলতে হবে। এ ছাড়া শিশুর পায়খানার সঙ্গে যদি রক্ত যায়, তাহলে অবহেলা না করে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
ঘাম : গরমে শিশুরা অত্যধিক ঘামে। এ কারণে শিশুর বুকে ঠাণ্ডা লেগে সর্দি-কাশি, এমনকি নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টও হতে পারে। এছাড়া অত্যধিক ঘামে শিশুর শরীর থেকে পানি ও লবণ বেরিয়ে যায়। ফলে শিশুর পানিশূন্যতা দেখা দেয়। তাই শিশু ঘেমে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তার শরীর মুছে দিয়ে কাপড় বদলে দিতে হবে। গরমে শিশুকে নিয়মিত গোসল করাতে হবে। পরিষ্কার রাখতে হবে শরীর ও পরিবেশ। এ সময়টায় শিশুকে প্রচুর পরিমাণে পানি ও তরল খাওয়ানো দরকার।
সর্দি-কাশি ও নিউমোনিয়া: গরমে শিশুদের ক্ষেত্রে ঠাণ্ডার সমস্যাটাও বেশি হতে দেখা যায়। গরমে অতিরিক্ত ঘামের ফলে ঠাণ্ডা লেগে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ ও নিউমোনিয়া হতে পারে। শিশুদের সংক্রমণের ফলে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ ও নিউমোনিয়ার লক্ষণগুলো অনেক ক্ষেত্রেই সুনির্দিষ্ট নাও হতে পারে। শিশুর শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কয়েকটি সাধারণ লক্ষণ হলো-জ্বর, দ্রুত ভারী ও ঘনঘন শ্বাসপ্রশ্বাস, শ্বাসের সঙ্গে শোঁ শোঁ শব্দ, বুকের পাঁজর বা খাচা ডেবে যাওয়া, খেতে না পারা বা খাওয়ানোতে অসুবিধা হওয়া, দুর্বল, ক্লান্তি বা ঝিমুনি ভাব
ঘামাচি : এ সময়ে শিশুর শরীরে ঘামাচি ওঠার প্রবণতা থাকে। তাই শিশুকে প্রতিদিন গোসল করিয়ে পরিষ্কার সুতির পোশাক পরাতে হবে। ঘেমে গেলে দ্রুত শরীর মুছে দিয়ে কাপড় বদলানো উচিত। ঘামাচির জায়গায় শিশুদের উপযোগী পাউডার ব্যবহার করতে হবে। পাউডার লাগানোর আগে শিশুর শরীর মুছে নিন নরম ভেজা কাপড় দিয়ে। গরমে শিশুকে বেশিক্ষণ ডায়াপার না পরিয়ে রাখাই ভালো। অনেক সময় ডায়াপারের কারণে ত্বকে ফুসকুড়ি হতে পারে। তাই খেয়াল রাখতে হবে, ভেজা ডায়াপার যেন বেশিক্ষণ পরিয়ে না রাখা হয়। ডায়াপার নষ্ট হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তা খুলে নতুন ডায়াপার পরাতে হবে।
ঘামাচি গরমের সবচেয়ে বড় সমস্যা। কিন্তু অনেকে বিষয়টিকে ততটা গুরুত্ব দেন না। ঘামাচি কমাতে অনেকেই পাউডার ব্যবহার করেন। তাতে হিতে বিপরীত হয়। পাউডারের কারণে ঘর্মগ্রন্থিগুলো সংক্রমণ হয়। তখন চিকিৎসকের কাছে ছুটতে হয়। তবে আগে থেকেই বিষয়টি নিয়ে সচেতন হলে বাড়াবাড়ি হওয়ার সুযোগ থাকে না।
এখন প্রচণ্ড গরম! উচ্চ তাপমাত্রার প্রথম শিকার হয় শিশুরা। শিশুরা খুব বেশি স্পর্শকাতর, তাই অন্য সময়ের তুলনায় গরমকাল শিশুদের জন্য বেশি কষ্টকর ও অসহনীয় হয়ে ওঠে। বড়দের মতো আবহাওয়ার দ্রুত তারতম্যের সঙ্গে শিশুরা নিজেকে মানিয়ে নিতে বেশিরভাগ সময়ই পারে না। গরমে জ্বর, পেট খারাপ, সর্দি, কাশিসহ নানা শারীরিক অসুস্থতা দেখা দেয়। এছাড়া ভাইরাসজনিত বিভিন্ন সংক্রমণ, শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন প্রদাহসহ নিউমোনিয়ায় ভুগতে পারে। এ সময়ে জলবসন্তসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগও বেশি হয়। প্রচণ্ড গরমে থাকে পানিশূন্যতা ও হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। আর এজন্যই গরমে শিশুর দরকার বাড়তি যত্ন।
[বাকি অংশ আগমীকাল]ইন্টার্ন শিক্ষার্থী
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল