গর্ভবতী নারীর যত্ন ও আমাদের ভবিষ্যৎ

ইরানী বিশ্বাস: আজ যে শিশু মায়ের গর্ভে রয়েছে, সে শিশুই সময়ের হাত ধরে জাতি ও রাষ্ট্রের কর্ণধার হয়ে উঠবে। সুতরাং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য মাতৃগর্ভেই সন্তানের সুরক্ষা নিশ্চিত জরুরি। বাংলাদেশে সঠিক বার্থ প্ল্যানিং বা জন্ম পরিকল্পনা থাকলেও নেই প্রাক-গর্ভপরিকল্পনা। অর্থাৎ বিবাহিত দম্পত্তি সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে অনাগত সন্তানকে স্বাগত জানায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারী অনাকাক্সিক্ষতভাবে গর্ভবতী হয়ে পড়ে, যে কারণে সন্তান ধারণের জন্য গর্ভবতী নারীর স্বাস্থ্য সবসময় গর্ভধারণের উপযুক্ত থাকে না। উন্নত বিশ্বে বিবাহিত দম্পত্তি সন্তান ধারণের আগে প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। এজন্য তারা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও সুষম খাবার গ্রহণ করে এবং শরীর যাতে সন্তান ধারণের উপযুক্ত হয়ে ওঠে, সে বিষয়ে বিশেষ খেয়াল রাখে। তবে বাংলাদেশে হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষিত দম্পতি ছাড়া অধিকাংশ নারী অনাকাক্সিক্ষত গর্ভবতী হয়। তাই এসব ক্ষেত্রে নারীর স্বাস্থ্য সন্তান গ্রহণে সবসময় উপযুক্ত থাকে না, কারণ সন্তান ধারণ থেকে শুরু করে সন্তানের পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখা পর্যন্ত একজন মাকে বিভিন্ন শারীরিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এ সময় মায়ের শারীরিক ঝুঁকি থাকে। ফলে গর্ভবতী মায়ের বিশেষ যতেœর বিকল্প নেই।

অনেক ক্ষেত্রেই অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ হয়ে থাকে। তাই নারী নিজেকে গর্ভবতী হিসেবে তখনই বুঝতে পারেন, যখন তিনি খেয়াল করেন মাসিকের তারিখ পেরিয়ে গেলেও মাসিক হচ্ছে না। একজন বিবাহিত নারী গর্ভধারণ নিশ্চিত করতে নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে গেলে রক্ত বা প্রস্রাব পরীক্ষার মাধ্যমে গর্ভ নিশ্চিতকরণ করা হয়।

গর্ভকালীন সেবা নিশ্চিত করার শুরুতেই গর্ভবতী নারীর নাম ও বয়স, ঠিকানা, স্বামীর নাম ও পেশা, বর্তমান গর্ভের তথ্য (শেষ মাসিকের তারিখ), পূর্ববর্তী প্রসব-সংক্রান্ত ইতিহাস (সন্তানসংখ্যা, প্রসব তারিখ, প্রসবের স্থান, প্রসব হতে কত সময় লেগেছিল, কাকে দিয়ে প্রসব করানো হয়েছিল, উচ্চ রক্তচাপ ছিল বা আছে কি না, খিঁচুনি হয়েছিল কি না, কোনো চিকিৎসাসেবা পেয়েছিল কি না, সিজার নাকি নরমাল, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়েছিল কি না প্রভৃতি জানতে চাওয়া হয়। পাশাপাশি গর্ভবতীর ওজন, ব্লাড গ্রুপ নির্বাচন, উচ্চ রক্তচাপ, এনিমিয়া, ডায়াবেটিস, জন্ডিস, হƒদরোগ ও প্রস্রাব পরীক্ষা করা হয়। যমজ গর্ভ, গর্ভস্থ শিশু ও প্ল্যাসেন্টার অবস্থানও নিশ্চিত করা হয় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে। এছাড়া শরীরের অন্যান্য উপসর্গ সম্পর্কে তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয় এবং যথাযথ পরামর্শ প্রদান করা হয়।

গর্ভকালীন একজন মাকে যে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়, তা-ই গর্ভকালীন সেবা। গর্ভধারণের সময় থেকে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত মা ও গর্ভস্থ শিশুর যতœকে গর্ভকালীন যত্ন বলে। এ যত্নের লক্ষ্য হলো মা ও গর্ভস্থ শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং গর্ভজনিত কোনো জটিলতা দেখা দিলে তা প্রতিরোধ করা বা এর চিকিৎসা দেয়া। একজন গর্ভবতী মায়ের গর্ভকালীন নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা এবং নিরাপদ প্রসব-পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা গর্ভবতী নারীর স্বামীসহ পরিবারের দায়িত্ব।

পুরো গর্ভাবস্থাজুড়ে গর্ভবতী মায়েদের ১৪ বার চেকআপ করার কথা থাকলেও আমাদের দেশে অন্তত চারবার চেকআপ করতে যাওয়া বাধ্যতামূলক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গর্ভবতী মাকে গর্ভকালীন সময়ে কমপক্ষে চারবার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চেকআপের জন্য যাওয়ার সুপারিশ করেছেন। গর্ভধারণের শুরু থেকে প্রসব পর্যন্ত মোট চারবার সেবা নিশ্চিত করা হয়। চতুর্থ মাসের মধ্যে প্রথমবার, ষষ্ঠ মাসে দ্বিতীয়বার, অষ্টম মাসে তৃতীয়বার ও নবম মাসে চতুর্থবার সেবা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

পাশাপাশি পাঁচ থেকে আট মাসের মধ্যে গর্ভবতী নারীকে দুটি টিটি টিকা নিতে হবে। বেশি পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার ও প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা আবশ্যক এ সময়। এছাড়া গর্ভকালে ভারী কোনো কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সবসময় হাসিখুশি থাকতে হবে এবং দিনে দু-এক ঘণ্টা বিশ্রাম ও রাতে অন্তত আট ঘণ্টা ঘুমানো জরুরি।

ঘরে বা অদক্ষ দাইয়ের হাতে নয়, যেকোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা ক্লিনিকে ডেলিভারি করানো নিরাপদ। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী দ্বারা ডেলিভারি করাতে হবে। তবে গর্ভকালে কোনো ধরনের জটিলতা দেখা দিলে অতি দ্রুত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।

প্রসব পরিকল্পনার সময় বাচ্চাকে কোথায় প্রসব করানো হবে, কোন ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীর বা দক্ষ দাই বা ধাত্রীর হাতে বাচ্চা প্রসব হবেÑপুরো বিষয়টি সম্পর্কে পরিকল্পনা করা জরুরি। প্রসবের সময় যদি সিজার করার প্রয়োজন হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় অর্থের ব্যবস্থা আগেই নিশ্চিত করতে হবে। যদি রক্তের প্রয়োজন হয়, তাহলে কোন জায়গা থেকে রক্ত পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি গর্ভবতী নারীকে হাসপাতালে নেয়া এবং ফিরিয়ে আনতে যাতায়াতের জন্য গাড়ির সুব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে আগে থেকেই। এসবই পরিকল্পনার অংশ।

অনেক পরিবারে গর্ভবতীকে কম খাবার খেতে দেয়া হয়। তাদের ধারণা মা বেশি খেলে পেটের বাচ্চা বড় হয়ে যাবে এবং স্বাভাবিক প্রসব হবে না। অনেকে গর্ভবতী মাকে বিশেষ কিছু খাবার, যেমন দুধ, মাংস কিছু কিছু মাছ ইত্যাদি খেতেও নিষেধ করেন। এ ধরনের ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে নিয়মিত জনসচেতনতামূলক প্রচারণার ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়েও গর্ভবতী মাকে নিজের যতœ সম্পর্কে বিশেষ পরামর্শ দিয়ে থাকে। পাশাপাশি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও গর্ভবতী নারীকে বিশেষ যত্ন নেয়ার বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে।

তবে গর্ভাবস্থায় শুধু বেশি খাবার গ্রহণ করলেই হবে না, বরং সঠিক পরিমাণে সুষম খাবার গ্রহণ করা উচিত। তাতে গর্ভবতী মা ও শিশুর স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, মা প্রসবের ধকল সহ্য করার মতো শক্তি পাবে এবং মায়ের বুকে বেশি বেশি দুধ তৈরি হবে। এছাড়া শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য আমিষজাতীয় খাবার, যেমন মাছ, মাংস, ডিম, ডাল ও দুধ বেশি করে খেতে হবে। এছাড়া সবুজ ও রঙিন শাকসবজি, তরকারি ও ফল ছাড়াও যেসব খাবারে আয়রন বেশি আছে, যেমন কাঁচাকলা, পালংশাক, কচু, কচুশাক, কলিজা ইত্যাদি প্রতিদিন নিয়ম করে খেতে হবে। এছাড়া পরিমাণমতো পানি পান করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, রান্নায় যেন আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করা হয়। গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিক কাজকর্ম করা শরীরের জন্য ভালো। তবে ভারী কাজ যেমন কাপড় ধোয়া, পানিভর্তি কলসি, বালতি এবং হাড়ি তোলা ঠিক নয়। বাড়িতে যদি টিউবওয়েল থাকে, তবে অবশ্যই পরিবারের সদস্যদের উচিত গর্ভবতী মাকে টিউবওয়েল ব্যবহার করতে নিষেধ করা। টিউবওয়েলে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা খুব বেশি।

গর্ভাবস্থায় মুড সুইং হতে পারে। বিষন্নতায় ভোগা একটি স্বাভাবিক বিষয়। হঠাৎ হঠাৎ মনের মধ্যে কষ্ট বেড়ে যেতে পারে। সামান্য কথায় কষ্ট পেতে পারে এ সময় গর্ভবতী মা। আবার প্রসব-পরবর্তীকালেও এ সমস্যা হতে পারে নারীর। তাই এ সময় পরিবারের সদস্যদের উচিত গর্ভবতী মায়ের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা। এ সময়ে অবশ্যই গর্ভবতীকে নিয়মিত ভালোভাবে গোসল করতে হবে। নিয়মিত দাঁত পরিষ্কার, চুল আঁচড়ানোসহ পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। সব সময় পরিষ্কার কাপড় পরিধান করতে হবে। সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি থাকলে মন ভালো থাকে। গর্ভাবস্থায় মন ভালো রাখা এবং সবসময় হাসিখুশি থাকা উচিত।

গর্ভধারণের ১৮-২০ সপ্তাহ পর থেকে মা গর্ভের বাচ্চার নড়াচড়া বুঝতে পারেন। পেটে বাচ্চার নড়াচড়া সন্তানের সুস্থতা সম্বন্ধে ধারণা দেয়। একটি সুস্থ বাচ্চা স্বাভাবিক পরিমাণ নড়াচড়া করে থাকে। এই নড়াচড়ার সংখ্যা কম হলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

অনেক সময় গর্ভাবস্থায় রক্তস্রাব হতে পারে, মাথাব্যথা করতে পারে। কখনও কখনও চোখে ঝাপসা দেখতে পারে গর্ভবতী মা। গর্ভাবস্থায় যে কোনো সময় খিঁচুনি দেখা দিতে পারে। আবার প্রসবের সময় বা প্রসবের পরও খিঁচুনি দেখা দিতে পারে। কখনও কখনও ভীষণ জ্বর হতে পারে। প্রসবের নির্দিষ্ট তারিখ পেরিয়ে গেলেও প্রসব বেদনা না হওয়া এবং নির্দিষ্ট তারিখের আগে প্রসব বেদনা হওয়া ক্ষতিকর। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এর যে কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে গর্ভবতী মাকে জরুরি সেবার জন্য দ্রুত হাসপাতালে বা নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে। দেশের সাধারণ জনগণের গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করতে জেলা হাসপাতাল, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ রয়েছে। দেশের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো এ সংশ্লিষ্ট সেবা নিশ্চিত করে।

সরকারের প্রশংসনীয় বহু উদ্যোগের মধ্যে ‘ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা তহবিল কর্মসূচি’ অন্যতম। এ সহায়তা দরিদ্র মা ও শিশুর স্বাস্থ্য ও পুষ্টি উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারের একটি অন্যতম সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম, যার মাধ্যমে গর্ভধারণকাল থেকে ২৪ মাস পর্যন্ত নির্ধারিত হারে নগদ অর্থ এবং আর্থ-সামাজিক ও সচেতনতামূলক সেবা প্রদান করা হয়। গর্ভবতী মায়েদের শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে সুস্থ ও সবলভাবে বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যসম্মত পরিচর্যা। তবে এই কর্মসূচি কেবল প্রথম ও দ্বিতীয় সন্তানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

একটি সুস্থ শিশু একটি দেশের সুস্থ নাগরিক। সুতরাং দেশের প্রতিটি শিশু সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠলে দেশে দক্ষ জনবল তৈরি হবে। মায়ের গর্ভে অপুষ্টি নিয়ে বেড়ে ওঠা শিশু মেধা ও মননে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পারে না। শিশুকে সুস্থভাবে জন্ম দেয়া প্রত্যেক বাবা-মায়ের দায়িত্ব। এজন্য গর্ভবতীর বিশেষ যত্ন নেয়ার পাশাপাশি সঠিক পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের মনে রাখতে হবে, সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থায় মা যদি মানসিক বা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়, তাহলে গর্ভজাত সন্তানের মানসিক ও শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা থাকে প্রবল। তাই সুস্থ-সুন্দর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার লক্ষ্যে গর্ভবতী মায়ের বিশেষ যত্ন নেয়া জরুরি, যেখানে সঠিক পরিকল্পনা একে অন্যের পরিপূরক। 

পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০