মজনুর রহমান আকাশ, গাংনী (মেহেরপুর): মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অনুমোদন ছাড়াই গড়ে উঠেছে ইটভাটা। আর এতে প্রতিদিন গড়ে ২০ হাজার মণ জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় এলাকার পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। ছড়াচ্ছে বিভিন্ন রোগবালাই। এতে পরিবেশ যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি নষ্ট হচ্ছে আবাদি জমি, উজাড় হচ্ছে গাছপালা, ভারসাম্য হারাচ্ছে প্রকৃতি।
প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কোনো অভিযানও চোখে পড়েনি। ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালীদের ক্ষমতার দাপট ছাড়াও বিশেষ ব্যবস্থায় এসব ইটভাটা চলছে বলে মন্তব্য সচেতন মহলের। তবে প্রশাসন বলছে, অভিযান চালানো হবে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, গাংনী উপজেলায় মোট ৪০টি ইটভাটা রয়েছে, যার একটিরও কোনো অনুমোদন নেই। প্রভাবশালী রাজনীতিকরা প্রশাসনের অনুমতি না নিয়ে ক্ষমতার জোরে ইটভাটা তৈরি করছে। সচেতন মহলের অভিযোগ, যেখানে-সেখানে ইটভাটা তৈরি হওয়ায় আবাদি জমিগুলো নষ্ট হচ্ছে। একটি ইটভাটা তৈরি করতে কমপক্ষে সাত-আট একর জমির প্রয়োজন হয়। অনেক সময় মাটির প্রয়োজন হলে এলাকার লোকজনের কাছ থেকে আবাদি জমির ওপরের এক থেকে দেড় ফুট মাটি কেটে ইট তৈরি করা হয়। এতে ফসলি জমির উর্বরাশক্তি নষ্ট হয়। শুধু তাই নয়, ইটভাটার নির্গত কালো ধোঁয়ায় এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে এবং আবাদি জমির ফসল নষ্ট হচ্ছে। কোনো ইটভাটায় অনুমতিপত্রের শর্তানুযায়ী কয়লা ব্যবহার করার কথা থাকলেও ব্যবহার করা হয় কাঠ। বিশেষ করে ফলদ ও বনজ বৃক্ষ ছাড়াও বাঁশের মোথা ব্যবহারের ফলে বাঁশঝাড় উজাড় হচ্ছে।
ইটপোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৮৯ ও ২০০১ সালের ১৭নং অনুচ্ছেদের ৪ ও ৫ ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, আবাদি জমিতে কোনো ইটভাটা তৈরি করা যাবে না। এছাড়া কাঠ পোড়ানো যাবে না। অথচ সকল ইটভাটায় কয়লার বদলে কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। মাঝেমধ্যে প্রশাসনের লোকজন জরিমানা আদায় করলেও ইটভাটা বন্ধ করে না। ফলে প্রভাবশালীরা প্রতি বছর নতুন নতুন ইটভাটা তৈরি করছে।
গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার রেজা জানান, ইটভাটায় নির্গত কালো ধোঁয়ায় মানুষের শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, ক্যানসারসহ নানা রোগের সৃষ্টি হয়। তাছাড়া অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের কারণে ফসল ও এলাকার পরিবেশ নষ্ট হয়। অনতিবিলম্বে পরিবেশ রক্ষায় প্রশাসনিক পদক্ষেপ জরুরি।
একটি সূত্র জানায়, এদিকে মাস দুয়েক আগে ইটভাটা চালু হলেও অদ্যাবদি প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও ভোক্তা অধিকার কোনো অভিযান পরিচালনা করেনি। প্রতি বছরই ইটভাটা মালিকদের কাছ থেকে মোট অঙ্কের টাকা উত্তোলন করে মালিক সমিতি। এ টাকা দিয়েই সব দপ্তরকে ম্যানেজ করতে হয়। এদিকে ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি এনামুল হক জানান, জেলা প্রশাসকের দপ্তরে আবেদন জানানো হয়েছে, কিন্তু অনুমোদন মেলেনি। সব জায়গাতে কথা বলে ম্যানেজ করেই ইটভাটা চালানো হয়। কাকে কীভাবে ম্যানেজ করেন, তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন তিনি।
ক্রেতারা জানান, গত বছর এক নম্বর ইটের দাম ছিল প্রতি হাজার ১৪ হাজার টাকা। বর্তমানে দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার টাকা। অভিযানের পরপরই দাম বেড়ে গেছে। আবার ইটের পরিমাপ সঠিক নয়। এক্ষেত্রে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর উদাসীন।
কুষ্টিয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আতাউর রহমান ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সজল আহমেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানান।
অবৈধ ইটভাটা পরিচালনা কাঠ পোড়ানোর ব্যাপারে গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রীতম সাহা জানান, ইটভাটা সংশ্লিষ্ট কয়েকটি দপ্তর জড়িত। সবাইকে নিয়ে সমন্বিতভাবে অভিযান চালানো হবে।
নতুন ফসলে তিস্তাপাড়ের কৃষকের মুখে হাসিফারুক আলম, লালমনিরহাট স্বচ্ছ পানির নদী হিসেবে তিস্তা-ধরলার পরিচিতি। নাব্য সংকটে বর্ষায় অল্প পানিতেই উপচে পড়ে; ভাঙে ঘরবাড়ি, ক্ষেত-খামার। তবে শুষ্ক মৌসুমে সম্পূর্ণ বিপরীত। জেগে ওঠা চরগুলো ফুলে-ফসলে ভরে ওঠে। বাদাম, ভুট্টা, আলু, মিষ্টিকুমড়াসহ নানা ফসল চাষে ব্যস্ত ও মুখর সময় পার করেন চরের কৃষকরা। অন্যবারের তুলনায় এবার তারা আরও বেশি খুশি।
সিকিমের চুংথাং বাঁধ ভেঙে যখন এক দিনে ভেসে যায় তিস্তা, তখন দুর্গতির কমতি না থাকলেও এখন তিস্তাপাড়ে খুশি। ওই বন্যায় স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি ঘোলাটে পানি আসে। পানি কমে গিয়ে তিস্তার চকচকে বালির ওপর এক থেকে তিন ফুট পর্যন্ত পলি জমেছে। আর এই পলিযুক্ত বালিতে অল্প সার ও পানি ব্যবহার করেই ফলানো হচ্ছে ফসল। এরই মধ্যে চরে চাষকৃত আমনের ব্যাপক ফলন হয়েছে। বাদামসহ বেশ কিছু সবজি চাষেও মিলেছে সাফল্য। সম্ভাবনা দেখাচ্ছে আলু, ভুট্টা, তামাক, রসুন, মিষ্টিকুমড়াসহ অর্থকরী ফসল।
কৃষি দপ্তরের মতে, গতবার রবি মৌসুমে আট হাজার ৫০০ হেক্টর চাষাবাদের আওতাভুক্ত ছিল। তবে তিস্তার চরে প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর চাষাবাদযোগ্য জমি আছে। প্রতিনিয়ত নতুন চরকে চাষযোগ্য করা হচ্ছে, যেখানে শুধু বালি আছে, সেখানে বিকল্প ব্যবস্থা করে চাষের আওতায় আনা হচ্ছে। রবিশস্য, ধান, পাট, আলু, বাদাম, ভুট্টা, পেঁয়াজ, মরিচ, ডালÑএসব অর্থকারী ফসল চরাঞ্চলেই বেশি উৎপাদিত হয়।
সদর উপজেলার খুনিয়াগাছের কৃষক মোফা মিয়া বলেন, এবার নিচু কিছু স্থানে দু-তিন ফুট পলি জমেছে। বালির ওপর এমন পলি আমার জীবনে দেখিনি। এবার যা-ই লাগানো হচ্ছে, দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। খরচ হচ্ছে কম, ফলন হচ্ছে ব্যাপক।
আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা ইউনিয়নের কৃষক রেজাউল ইসলাম বলেন, এবার ভারতের বাঁধ ভেঙে যে পানি খুব ঘোলা পানি এসেছে। এমন ঘোলা পানি কখনও আসেনি। সাদা বালি কালো হয়ে গেছে। এবার খুব ভালো ফলন হচ্ছে।
একই ইউনিয়নের রাব্বানি আজিজার বলেন, যেখানে কখনও ধান হতো না। এবার ধান হয়েছে। অন্যবার যে চরে সারপানি দিয়ে বিঘায় ছয় মণ ধান হতো, এবার সেখানে ১৮ থেকে ২০ মণ পর্যন্ত ধান হয়েছে।
কালিগঞ্জের চর শৌলমারির কৃষক আব্দুর রহিম মিষ্টিকুমড়া লাগিয়েছেন ২৮ দিন আগে। এখন পর্যন্ত কোনো সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করেননি। গাছ হƒষ্টপুষ্ট হয়ে চার-পাঁচ ফুট লম্বা হয়েছে। আশা করছেন এবার খুব কম খরচে বেশ ভালো ফল পাবেন।
ভোটমারি ব্লোকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম বলেন, চরে আমার দুই জায়গায় চার একর পর্যন্ত বালিতে মিষ্টিকুমড়া চাষ হচ্ছে। কৃষি উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে মিষ্টিকুমড়া ও তরমুজ চাষ হচ্ছে। তরমুজের সাথি ফসল হিসেবে ক্ষীরা চাষ হচ্ছে। এছাড়া ভুট্টা, ধান, পেঁয়ঁজ, পেঁয়াজবীজ, লাউ, গমসহ অন্যান্য ফসল চাষ হচ্ছে।
মৃত্তিকা গবেষণা ইনিস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, উঁচু স্থান বা পাহাড় থেকে যে পানি আসে, তা বিভিন্ন নিউট্রিয়ান্ট বা পুষ্টি নিয়ে আসে। বন্যার পানিতে কয়েকটি স্তর আছে। প্রথমত, তিনটি স্তরÑবালি, পলি ও ফেনা। বালির ওজন বেশি হওয়ায় প্রথমে বালিটা পড়বে, তার ওপর পলি বা ঘোলা, তার ওপর ফেনা। যেখানে শুধু বালি পড়বে, সেখানে ভালো জমিও নষ্ট হয়ে যাবে। আর পলির সঙ্গে পানির যে ফেনা অংশ থাকে, এটা পড়লে যে কোনো অনুর্বর জমি উর্বর হবে। এটা আশীর্বাদ। সাধারণ ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত পলি জমে।
লালমনিরহাট কৃষি দপ্তরের সৈয়দ সিফাদ জাহান (উপপরিচালক, শস্য) বলেন, পলি প্রতি বছর পড়ে। এবার সিকিমের বন্যার পরে বেশি পড়েছে। এখন পর্যন্ত প্রতি হেক্টরে ৩.০২ মেট্রিক টন (চালের হিসাব) আমনের ফলন পাওয়া গেছে। চূড়ান্ত হিসাব এখনও করা হয়নি। পলির পড়ার ফলে প্রচুর মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট জমিতে থাকে। জমির অপুষ্টির লক্ষণ প্রকাশ না ঘটলে রাসায়নিক সার দিতে হবে না। তবে কিছু জমিতে মাটির কিছু খাদ্য উপাদান দিতে হতে পারে।