মজনুর রহমান আকাশ, গাংনী (মেহেরপুর): মেহেরপুরের গাংনীতে চলতি মৌসুমের প্রথমদিকে পাটের দাম কিছুটা বাড়তি থাকলেও বতর্মানে কমেছে পাটের বাজার দর। তাই উৎপাদন খরচ উঠাতে কৃষকদের চোখ এখন পাটকাঠির দিকে। পাটখড়ির নানাবিদ ব্যবহারের ফলে যথেষ্ট চাহিদাও বেড়েছে পাটকাঠির। বাণিজ্যিকভাবে পাটকাঠির ব্যবহার বৃদ্ধিতে এর প্রতি যত্নবান হয়েছেন কৃষকরা। পাটকাঠির কাক্সিক্ষত দাম পাওয়ায় অনেক চাষি পাট চাষের খরচ উঠাতে পারছেন বলে জানিয়েছেন চাষিরা।
পাটচাষিরা বলছেন, অনাবৃষ্টি, শ্রমিক সংকট ও মজুরি বৃদ্ধি, পাট পচানোর জন্য পুকুর ভাড়াসহ নানা কারণে পাটের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। অথচ বাজারে পাটের দাম একেবারই কম। অধিকাংশ চাষিরা গর্তখুঁড়ে শ্যালো ইঞ্জিনের মাধ্যমে পানি দিয়ে দিচ্ছেন পাট জাগ। ফলে পাটের আঁশের রং নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কমে যাচ্ছে বাজারমূল্য। তবে পরিবর্তন হচ্ছে না শুধু পাটখড়ির। তাই পাটের আঁশের লোকসান পুষিয়ে নিতে পাটকাঠিতেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন চাষিরা।
জেলার গাংনী উপজেলার সিন্দুরকৌটা গ্রামের পাটচাষি আকবর আলী জানান, তিনি পাঁচ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছেন। এলাকাভিত্তিক মাটির উর্বরতা একেক রকম। কোনো কোনো এলাকার মাঠে এক বিঘা জমিতে পাট হয় ৮ থেকে ১০ মণ। আবার কোথাও কোথাও ১২ থেকে ১৪ মণ। বতর্মানে বাজারে নতুুন পাটের দাম চলছে ১ হাজার ৮০০ টাকা ২ হাজার টাকা মণ। আর এক বিঘা জমিতে পাটকাঠি হয় ১৩০ আঁটি। চাহিদা অনুযায়ি প্রতি আঁটি পাটকাঠি বিক্রি হয় ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। তাতে বিঘাপ্রতি পাটকাঠিতে আসে সাড়ে ৫ হাজার টাকা। গত বছর একইভাবে পাটকাঠি বিক্রি করে মোটা টাকা আয় করেছেন তিনি।
গাংনী উপজেলার কোদাইলকাটি গ্রামের পাটচাষি আব্দুল গণি জানান, এ এলাকার মাটি মোটা। এখানে প্রতি বিঘা জমিতে পাট উৎপাদন হয় ১৩ মণের মতো। আবার এলাকায় নদী থাকাই পাটের জাগ ভালো হয়। এতে পাটের আঁশের রং ভালো আসে ও পাটকাঠিও ভালো থাকে। এতে পাট ও পাটকাঠির দাম ভালো পাওয়া যায়। প্রতি বিঘা জমিতে আমরা পাটকাঠি বিক্রি করি ৭ থেকে ৮ হাজার টাকার মতো। এ বছর এক বিঘা জমির পাট চাষ করে তা জাগ দিয়ে ঘরে তুলতে ১৭ হাজার টাকার কাছাকাছি খরচ হয়ে যাচ্ছে। আর পাট বিক্রি করে টাকা জমছে ১৮ হাজারের মতো। তাই এখন ভরসা পাটকাঠিতে।
পাটকাঠি ব্যবসায়ী শিমুলতলার জালাল উদ্দীন জানান, তিনি দেড় যুগ ধরে পাটকাঠির ব্যবসা করছেন। এলাকার পুকুরের পানিতে জাগ দেয়া পাটকাঠির চেয়ে নদীর পানিতে জাগ দেয়া পাটের পাটকাঠির কদর বেশি। এমনিতেই ব্যবসায়ীরা বিঘাপ্রতি পাটকাঠি অনুমান দরে কিনে তা পরিষ্কার করে বিক্রি করেন। এখন পাটের চেয়ে পাটকাঠির দর বেশি এবং চাহিদাও অনেক বলে জানালেন এই ব্যবসায়ী। তিনি আরও জানান, মোটা ও এটেল মাটির পাট বেশ বড় হয়। পরিষ্কার পানিতে পাট জাগ দেয়া বড় পাটকাঠির চাহিদা ও দাম দুটোই বেশি। পানচাষি আলমডাঙ্গার রোয়াকুলি গ্রামের ভুলু মিয়া জানান, পানের বরজের ক্ষেত্রে পাটকাঠির বিকল্প নেই। বরজ ঘেরা, ছাউনি থেকে শুরু করে সারিবদ্ধভাবে পানের গাছ দাঁড় করিয়ে রাখতে পাটকাঠি লাগবেই। এমনও সময় আছে ভালোমানের পাটকাঠির জন্য ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা বায়না করে রাখেন বরজের মালিকরা। একই কথা জানালের ফুলবগাদির হাফিজ ও অনুপনগরের জাহাঙ্গীর। তারা জানান, বাঁশের ফালি কিনতে বেশি টাকা লাগে; তাই বিকল্প হিসেবে পাটকাঠি ব্যবহার করা হয়।
রায়পুর বাজারের পাট ব্যবসায়ী আব্দুল হান্নান জানান, আড়তে গত বছরের বেশ কিছু পাট মজুত রয়েছে। দাম কম থাকায় লোকসানের জন্য তা বিক্রি করা হয়নি। কিন্তু এ বছরও কাক্সিক্ষত দাম পাওয়া যাচ্ছে না। চলতি মৌসুমের শুরুতে নতুুন পাট কেনা হয় প্রকার ভেদে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা। এবার অনেক চাষি ও ব্যবসায়ীকে লোকসান গুনতে হবে।
গাংনী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এমরান হোসেন জানান, চলতি মৌসুমে ২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করা হয়। চলতি মৌসুম জেলায় অনাবৃষ্টি ও শ্রমিক সংকটের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। বতর্মানে পাটের দাম কিছুটা কম হলেও তা যে কোনো সময় বাড়তে পারে। তাছাড়া পাট চাষ করে পাটের আঁশ ছাড়িয়ে নেয়ার পর যে পাটখড়ি বা পাটকাঠি পাওয়া যায় স্থানীয়ভাবে তারও যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে ও এর মূল্য বেশি। আবার জায়গা বিশেষ পাটকাঠি বিক্রি করে উৎপাদনের খরচ উঠে যায়। তাছাড়া আমাদের দেশে জ্বালানি হিসেবে, বাড়িঘর ও সবজি ক্ষেতের বেড়া, মাচা, পান বরজ, ইত্যাদি কাজে পাটকাঠির ব্যবহার দীর্ঘকাল আগে থেকেই হয়ে আসছে। পাটকাঠি অবশ্যই চাষিদের জন্য আশীর্বাদ।