গাজর চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন কৃষক। আজ থাকছে এর বিভিন্ন দিক নিয়ে সঠিক নিয়মে চাষাবাদ
সঠিক নিয়মে চাষ করলে গাজরের ভালো ফলন পাওয়া যায়। পুষ্টিগুণে অনন্য গাজর, তাই এর চাহিদা তুলনামূলক বেশি। এটি শীতকালীন ফসল হলেও চাষিরা প্রায় সব মৌসুমে চাষ করে থাকেন। এ কারণে বছরের প্রায় সব সময়ই পাওয়া যায়। দেশের প্রায় সব জায়গায় গাজরের চাষ হয়।
গাজর চাষের জন্য দোআঁশ বা বেলে দোঁআশ মাটি উপযুক্ত। গাজর সব সময় চাষ করা হলেও মূল সময় হচ্ছে আশ্বিন থেকে কার্তিক। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত গাজর বপনের উত্তম সময়। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া গাজরের জন্য প্রযোজ্য। সে অনুযায়ী জমি নির্বাচন করতে হবে। তাপমাত্রা ও মাটির প্রকৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয় এ সবজিটি। তাই আবহাওয়া ও মাটির উর্বরাশক্তি কম-বেশি হলে গাজর চাষ ব্যাহত হয়। সুতরাং এদিক থেকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।
জাত
আমাদের দেশে গাজরের এখনও কোনো অনুমোদিত জাত নেই। তবে দুই ধরনের গাজর চাষ হয়ে থাকে। একটি গ্রীষ্মকালীন; অপরটি নাতিশীতোষ্ণ। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাত হচ্ছে কুয়োদা নিউ, সানটিনি, রয়েল ক্রস প্রভৃতি। অন্যদিকে আমদানি করা বিভিন্ন জাতের গাজর চাষ করা হয়ে থাকে। জনপ্রিয় জাতের মধ্যে পুসা কেশর, করোদা রেড, করোদা সানটিনি, সাইন করোডা অন্যতম। এসব জাতের মধ্যে পুশাকেশর জাতটি আমাদের আবহাওয়ায় বীজ উৎপাদনে সক্ষম।
জমি প্রস্তুতকরণ
গাজর চাষকৃত জমি মূলত আট থেকে ১০ ইঞ্চি গভীর করে চাষ করে নিতে হবে। কেননা, গাজরের শেকড় অনেক গভীরে প্রবেশ করে। এ জমি একাধিকবার চাষ করা আবশ্যক। তাই তিন থেকে চারবার চাষ করে নিতে হবে। এরপর মই দিতে হবে। এতে জমি খুব ভালোভাবে তৈরি হবে ও মাটি ঝুরঝুরে হবে।
বপন পদ্ধতি
গাজরের বীজ সারিবদ্ধভাবে বপন করতে হয়। জমিতে বীজ বপনের আগে গাজরের বীজ একদিন ভিজিয়ে রাখতে হবে। মাটি উত্তমরূপে তৈরি করে ২৫ সেমি ব্যবধানের সারি করে সারিতে বীজ বুনতে হয়। বীজ খুব ছোট বলে ছাই বা গুঁড়ো মাটির সঙ্গে মিশিয়ে বপন করা ভালো। দুই থেকে তিন ইঞ্চি দূরে দূরে বীজ বপন করতে হবে। বীজ গজানোর পর চারা একটু শক্ত হলে পর্যায়ক্রমে চারা পাতলা করে দিতে হয়। এতে চারা থেকে চারার দূরত্ব পাঁচ সেমি হলে গাজর খুব ভালো হয়। প্রতিটি বেডের প্রস্থ হতে হবে এক মিটার করে। দুই বেডের মাঝে সেচ দেওয়া ও পরিচর্যার জন্য ২০ সেমি গভীরতাবিশিষ্ট ৩০ সেমি চওড়া নালা রাখতে হবে।
সার দেওয়া
গুণগত মানসম্মত ফসল পেতে হলে জমিতে সার দিতে হবে। জৈবসার প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। জৈবসার মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ দুটোই ভালো রাখে। কৃষি অধিদফতরের কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী বিভিন্ন সার প্রয়োগ করতে হবে। এসব সারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গোবর, ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, জিংক সালফেট প্রভৃতি।
পরিচর্যা
বীজ বপনের পর চাষকৃত জমিতে অল্প পরিমাণে সেচ দিতে হবে। চারা ছোট অবস্থায় নিড়ানি দিয়ে জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে। চারা বের হতে শুরু হলে আরও একবার সেচ দিয়ে নেওয়া ভালো। এতে অঙ্কুরোদ্গম ভালো হবে। ফসল তোলার সময় আরও একবার সেচ দিয়ে নিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, সেচের পানি নালায় যেন না জমে থাকে। তাহলে ফসলের ক্ষতি হতে পারে। তাই পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
জমিতে চারা গজানোর আড়াই মাস পর গাজর খাওয়ার উপযোগী হয়ে ওঠে। তবে পুষ্ট ও ভালোমানের গাজর পেতে জমি থেকে চার মাস পর ফসল সংগ্রহ করতে হবে।
পুষ্টিতে পরিপূর্ণ সবজি
পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ একটি সবজি গাজর। হালুয়া, সালাদ কিংবা রান্না ছাড়াও কাঁচা খাওয়া যায়। এ সবজি খেলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
# গাজরে ক্যালরির পরিমাণ কম। ১৫০ গ্রাম ওজনের দুটি বড় মাপের গাজরে থাকে ৬০ ক্যালরি। এতে পর্যাপ্ত পরিমাণ আঁশ বা ফাইবার রয়েছে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’, ‘সি’, ‘কে’, প্যানটোথেনিক এসিড (বি৫), ফোলেট (বি৯), পটাসিয়াম, আয়রন, তামা বা কপার ও ম্যাঙ্গানিজ রয়েছে
# গাজরে রয়েছে বিটা ক্যারোটিন। এ ক্যারোটিনয়েড অ্যান্টি-অক্সিডেন্টটি ভিটামিন ‘এ’তে রূপান্তরিত হয়। ভিটামিনটি চোখ ভালো রাখে, দৃষ্টিশক্তি বাড়াতেও সাহায্য করে
# গাজরের ক্যারোটিনয়েড ভেঙে শরীরে চর্বির সঙ্গে মিশে যায়। যকৃৎ থেকে নিষ্কৃত পিত্তরস ভালোভাবে প্রবাহিত হতে সাহায্য করে। ফলে যকৃতের বর্জ্য দূর হয়; যকৃৎ সুস্থ রাখে
# ফুসফুস ও প্রস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়
# দাঁতের সুরক্ষায় গাজর খেতে পারেন
# গাজরে থাকা আলফা ক্যারোটিন হৃৎপিণ্ড সুরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় সবজিটি রাখতে পারেন
# রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে গাজরের জুড়ি মেলা ভার
# স্থূলতা রোধে বেশি করে গাজর খান, উপকৃত হবেন
# গাজরে থাকা ভিটামিন ও মিনারেল চুল পড়া কমায়। এমনকি চুলের গোড়া শক্ত ও মজবুত করে
# সুন্দর ত্বকের জন্য গাজর খেতে পারেন। এর মধ্যে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন ব্রন ও চামড়া ঝুলে পড়া রোধ করে
# গাজর দিয়ে তৈরি করতে পারেন মজার খাবার। হালুয়া, সেমাই, লাড্ডু, জুস, মার্মালেড, কুনাফা, চিপস, চাটনি, কেক, স্যুপ, জর্দা, পুডিং প্রভৃতি বেশ মজার। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, সর্বোচ্চ পুষ্টি পেতে কাঁচা গাজর খাওয়াই উত্তম।
সুপ্রাচীনকাল থেকে…
প্রাচীনকাল থেকেই এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাওয়া যায় গাজর। বলা হয়, বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলে জন্মে এ সবজিটি। বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্য হিসেবে এটি বেশ জনপ্রিয়।
সারা বিশ্বে প্রতি বছর ৪০ মিলিয়ন টনের বেশি গাজর উৎপন্ন হয়। চীনে সবচেয়ে বেশি উৎপন্ন হয়। মোট গাজরের ৪৫ শতাংশ উৎপাদন করে দেশটি। অর্থাৎ বিশ্বের প্রায় অর্ধেক গাজরই উৎপাদন হয় চীনে। রাশিয়া ও উজবেকিস্তানে প্রায় ৯ শতাংশ উৎপন্ন হয়। যুক্তরাষ্ট্রে এ হার তিন দশমিক পাঁচ শতাংশ। বাণিজ্যিক উৎপাদনে পিছিয়ে নেই ইউক্রেন, পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানি, তুরস্ক, ইতালি, ফ্রান্স, ভারত, কানাডা ও মেক্সিকোও।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার অঙ্গরাজ্যে দেশটির অন্য রাজ্যের তুলনায় বেশি গাজর উৎপন্ন হয়। এরপরে রয়েছে মিশিগান, টেক্সাস, ওয়াশিংটন ও উইসকনসিন।
যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিক বছরে প্রায় পাঁচ পাউন্ড গাজর খেয়ে থাকেন। দেশটিতে জনপ্রিয় খাদ্য তালিকার ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে গাজর।
গাজরের সালাদ, হালুয়া, বরফি, আচার, পুডিং, ক্যারট রাইস, ক্রানচি ক্যারট, বিভিন্ন ধরনে ডেজার্ট, কেক, জেলি, সুশি রোল, আইসক্রিম প্রভৃতি ভীষণ জনপ্রিয়।
রোগ ও প্রতিকার
চাষকৃত জমিতে আগাছা থাকলে পোকামাকড় ও রোগ জীবাণুর আক্রমণ বেশি হয়। গাজরের কিছু রোগবালাই ও প্রতিকার সম্পর্কে জেনে রাখতে পারেন
জাব পোকা
জাব পোকা গাজরের পাতা ও গাছের কচি অংশের রস চুষে খেয়ে ফসলের ক্ষতি করে। গাছ আর বাড়তে পারে না। গাজর ছোট আকারের হয়। কখনও কখনও গাজর হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে না
প্রতিকার: পোকা দমনের জন্য কৃষি অধিদফতরের পরামর্শ অনুযায়ী যে কোনো ইমিটাক্লোপ্রিড ২০ এসএল শূন্য দশমিক ২৫ মিলিলিটার পরিমাণমতো পানির সঙ্গে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এছাড়া কীটনাশকের যে কোনো একটি অনুমোদিত মাত্রায় ব্যবহার করা যেতে পারে
হলুদ ভাইরাস
গাজরের রোগবালাই তুলনামূলক কম হয়। পোকামাকড়ের আক্রমণও কম। তবে অনেক সময় হলুদ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। এটি মূলত লিফ হপার পোকার কারণে হয়। রোগটি দেখা দিলে গাজরের ছোট বা কচি পাতা হলুদ হয়ে কুঁকড়ে যায়। পাতার পাশের ডগা হলুদ ও বিবর্ণ হয়ে পড়ে
প্রতিকার: আক্রান্ত ডালপালা কেটে ফেলতে হবে। চারপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কৃষি দফতরের পরামর্শ অনুযায়ী সবিক্রন ৪২৫ ইসি দুই মিলিলিটার অথবা রেলোথ্রিন এক মিলিলিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে
কালো মূল পচা
গাছের মূল ও পাতার গোড়ায় ব্যাকটেরিয়াজনিত পচন রোগ হতে পারে। মূলে কালো দাগও দেখা যায়। নাইট্রোজেন সার অতিরিক্ত প্রয়োগে এমন হতে পারে
প্রতিকার: অতিরিক্ত ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা যাবে না। ইন্ডোফিল এম-৪৫ দুই গ্রাম এক লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে
নরম পচা রোগ
ছত্রাকজনিত রোগ নরম পচা। এ রোগ দেখা দিলে পাতা ও গাছের গায়ে সাদা পাউডারের মতো দাগ দেখা যায়, যা ধীরে ধীরে পুরো পাতায় ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত বেশি হলে পাতা হলুদ বা কালো হয়ে মারা যায়। মূলক ফসল বাড়ার সময়ে এ রোগ অক্রমণ করে
প্রতিকার: কৃষি অধিদফতরের অভিজ্ঞ কর্মীরা কপার অক্সিক্লোরাইড জাতীয় ছত্রাকনাশক কিছুদিন পরপর শেষ বিকালে স্প্রে করার পরামর্শ দেন
শেকড় পচা
গাজরের প্রধান শেকড়ের আগা অথবা গায়ের শেকড়ে অনেক সময়ে পচন ধরে। ফলে ধীরে ধীরে গাজরের উপরিভাগ দিক পচতে থাকে
প্রতিকার: আক্রমণের শুরুতেই আক্রান্ত গাছের অংশ সংগ্রহ করে নষ্ট করতে হবে। এছাড়া কপার অক্সিক্লোরাইড দুই গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে
চারা ঢলে পড়া
আক্রান্ত চারার গোড়ার চারদিকে পানিভেজা দাগ দেখা যায়। গোড়ার সাদা ছত্রাকজালি ও অনেক সময় সরিষার মতো ছত্রাকের অনুবীজ পাওয়া যায়। ফলে শেকড় পচে যায়, চারা নেতিয়ে পড়ে। অবশেষে গাছ মরে যায়। স্যাঁতসেঁতে মাটি হলে এ রোগের প্রকোপ বাড়ে
প্রতিকার: পর্যাপ্ত জৈব সার দিতে হবে। সরিষার খৈল পরিমাণমতো প্রয়োগ করতে হবে। দিনের বেশিরভাগ সময় ছায়া পড়ে এমন জমিতে গাজর চাষ না করাই উত্তম।
সফলতা
গাজর অত্যন্ত লাভজনক একটি সবজি। তাই গাজর চাষ করে অনেক চাষি তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছেন। তাদের দেখাদেখি অনেকে সবজিটি চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
আকারে ছোট হলেও উচ্চ পুষ্টিমানসমৃদ্ধ ফসল গাজর। তাই এ সবজি চাষে চাষির লাভ হচ্ছে বেশি। স্বল্প সময় ও কম পরিশ্রমে গাজরের ভালো উৎপাদন হয়। তাই গাজর চাষে বেশ আগ্রহ বাড়ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন জেলার প্রায় সব এলাকায় স্থানীয় চাহিদা মেটাতে চাষিরা গাজর চাষ করে থাকেন। তবে মানিকগঞ্জ ও নওগাঁয় অধিক পরিমাণে গাজর চাষ হয়ে থাকে। প্রতি বিঘায় প্রায় ১৫০ মণ পর্যন্ত উৎপাদন হয়ে থাকে। চাষাবাদের জন্য পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা খরচ হয়। লাভ তুলনামূলক বেশি। সংশ্লিষ্টদের মতে, গাজর উৎপাদন ভালো হওয়ায় আগামীতে এর চাষ আরও বৃদ্ধি পাবে।
গাজর চাষে তেমন কোনো খরচ নেই, উত্তোলন করার পর গাজরের পাতা গরুর খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। দেশের চাহিদা মিটিয়ে উৎপাদিত গাজর রফতানি করা হচ্ছে। লাভজনক হওয়ায় চাষিরা গাজর চাষে ঝুঁকছেন ঠিকই; কিন্তু হিমাগারের অভাবে তারা প্রতি মৌসুমে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। গাজর রাখার জন্য পর্যাপ্ত হিমাগারের ব্যবস্থা করা হলে এক মৌসুমের ফসল অন্য মৌসুমে বিক্রি করে আরও লাভবান হতে পারবে কৃষক।