রহমত রহমান: রাস্তায় চলছে কোটি কোটি টাকার বিলাসবহুল গাড়ি। কিন্তু আয়কর ফাইলে গাড়ি দেখানো হয় না। গাড়ি কেনার টাকার উৎস থেকে যায় পর্দার আড়ালে। কারণ বেশিরভাগ গাড়ি ভুয়া ই-টিআইএন (স্বয়ংক্রিয় করদাতা শনাক্তকরণ নাম্বার) দিয়ে নিবন্ধন নেওয়া। ফলে এসব গাড়ি মালিকদের খুঁজেও পাওয়া যায় না।
যদিও গাড়ি নিবন্ধন ও ফিটনেস নবায়নে ই-টিআইএন বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ই-টিআইএন যাচাই করতে পারে না। ফলে টিআইএন ভুয়া না সঠিক, গাড়ির মালিক কর দেয় কি না তা জানতে পারে না। এছাড়া এনবিআরের সঙ্গে বিআরটিএ অনলাইন কানেক্টিভিটি না থাকায় কারা নিবন্ধন বা ফিটনেস নবায়ন করেছে তা জানতে পারে না। ফলে বহু গাড়ির মালিক দীর্ঘদিন ধরে গাড়ি নিবন্ধন ও ফিটনেস নবায়নে ভুয়া ই-টিআইএন ব্যবহার করে আসছে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ভুয়া ই-টিআইএন ব্যবহার রোধ বিআরটিএকে ই-টিআইএন যাচাইয়ে ইউজার আইডি, পাসওয়ার্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর। সম্প্রতি এনবিআরের এক ভার্চুয়াল সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় বিআরটিএ, ব্যাংকের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। এতে সভাপতিত্ব করেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম।
সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চল বিআরটিএ থেকে এক হাজার ৮২১টি বিলাসবহুল গাড়ির তথ্য সংগ্রহ করে। এসব গাড়ির ই-টিআইএন যাচাই করে ১২৬টি গাড়ির ই-টিআইএন ভুয়া পাওয়া যায়। মূলত করফাঁকি দিতেই গাড়ি মালিকরা ভুয়া ই-টিআইএন ব্যবহার করে আসছে। এ তথ্যের পর নড়েচড়ে বসে এনবিআর। গাড়ি নিবন্ধন ও ফিটনেস নবায়নে ভুয়া ই-টিআইএন ব্যবহার বন্ধে ই-টিআইএন যাচাইয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সভায় ভুয়া ই-টিআইএন ব্যবহার রোধ এবং ই-টিআইএনের সঠিকতা যাচাই বিষয়ে কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বিআরটিএ কর্তৃক ভুয়া ই-টিআইএনের বিপরীতে যেন মোটর গাড়ি রেজিস্ট্রেশন করা না হয়। বিআরটিএ কর্মকর্তারা এ পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআরের ওয়েবসাইট থেকে ই-টিআইএন যাচাই করতে অসুবিধার কথা জানান। সভায় ভুয়া ই-টিআইএন যাচাই করতে বিআরটিএকে আইডি ও পাসওয়ার্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে নিবন্ধনের টাকা জমা দিতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকও ই-টিআইএন যাচাই করবে। ব্যাংকে আগে থেকেই ই-টিআইএন যাচাই করতে আইডি, পাসওয়ার্ড দেওয়া আছে।
সভায় এনবিআর সদস্য (করনীতি) মো. আলমগীর হোসেন বলেন, বিআরটিএকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি আইডি ও পাসওয়ার্ড প্রদান করা হলে তার মাধ্যমে কর্মকর্তারা টিআইএন যাচাই সম্পন্ন করতে পারবেন। একইসঙ্গে যাচাই প্রক্রিয়াটির অপব্যবহারও রোধ করা সম্ভব হবে। সদস্য (কর জরিপ ও পরিদর্শন) রঞ্জন কুমার ভৌমিক বলেন, ইতোমধ্যে বিআরটিএকে এনবিআর থেকে টিআইএন যাচাইয়ের জন্য ৯টি আইডি ও পাসওয়ার্ড প্রদান করা হয়েছে, যা ব্যবহার করে বিআরটিএ সহজেই ভুয়া টিআইএন শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। সভায় এনবিআরের আইটি উইংয়ের মাধ্যমে বিআরটিএ’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের টিআইএন যাচাই পদ্ধতির ওপর প্রশিক্ষণ প্রদানে নির্দেশ দেন এনবিআর চেয়ারম্যান।
একইসঙ্গে গাড়ির অগ্রিম আয়কর জমাদান পদ্ধতি, ভুয়া টিআইএন ব্যবহার রোধ এবং গাড়ির মালিকদের তথ্য আদান-প্রদানের জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদ্যমান পদ্ধতির উন্নতির প্রয়োজন রয়েছে তা চিহ্নিত করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করার জন্য অভিমত ব্যক্ত করলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান তাতে একমত পোষণ করেন। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এনবিআরের সিস্টেমস ম্যানেজার মো. শফিকুর রহমানকে আহ্বায়ক ও সিস্টেম অ্যানালিস্ট মো. গোলাম মোস্তফাকে সদস্য সচিব করে আট সদস্যের একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়।

কমিটিতে এনবিআরের দুজন দ্বিতীয় সচিব, বিআরটিএ পরিচালক (অপারেশন) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস, সিনিয়র কম্পিউটার অপারেটর এএইচএম আনোয়ার পারভেজ, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট কাজী মো. সাফায়েত কবীরকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়। এ কমিটি টাস্কফোর্সের মতো কাজ করবে। ঈদের পর কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে। কমিটি গাড়ির অগ্রিম কর জমাদান পদ্ধতি, ভুয়া টিআইএন ব্যবহার রোধ এবং মালিকদের তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে বিআরটিএ-এনবিআরের মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে সুপারিশমালা প্রণয়ন করবে। সহসাই এনবিআর চেয়ারম্যানকে এর ওপর একটি প্রতিবেদনও দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে কমিটির সদস্য ও বিআরটিএ পরিচালক (অপারেশন) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা এখন আইডি, পাসওয়ার্ড পাইনি। পেলে ঢাকার কয়েকটি অফিসে প্রাথমিকভাবে ই-টিআইএন যাচাইয়ের কাজ শুরু করব। তিনি বলেন, ব্যাংকের চার শতাধিক শাখা, বিআরটিএ ৭০টি অফিস। মাত্র ৯টি আইডি, পাসওয়ার্ড দিয়ে তো হবে না। আর আমরা চাইব আমাদের সিস্টেম থেকে যাচাই করার জন্য। এনবিআরের সিস্টেম থেকে যাচাই করতে গেলে অনেক সময় লাগবে।’ কমিটির সভায় এসব তুলে ধরা হবে বলে জানান তিনি।

কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চল সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রায় ৩৭ লাখ গাড়ি বিআরটিএ নিবন্ধিত আছে। এর মধ্যে বিএমডব্লিউ, ভলভো, মার্সিডিজ বেঞ্জ, আউডি, লেক্সাস, জাগুয়ার, হ্যামার, প্রাডো ও হ্যারিয়ারের মতো গাড়ি রয়েছে। জরিপ বিভিন্ন সময় বিআরটিএ থেকে এক হাজার ৮২১টি বিলাসবহুল গাড়ির তথ্য সংগ্রহ করে। ৮২১ গাড়ি যাচাই করে দেখতে পায়, ১২৬টি গাড়ির নিবন্ধনে জাল টিআইএন ব্যবহার করা হয়েছে। এসব গাড়ির মালিকরা আয়কর বিভাগে নিবন্ধিত করদাতা নন। অনিবন্ধিত ও জাল টিআইএনধারী গাড়ির মালিকদের আয়কর নথি না থাকায় বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি হচ্ছে।
আয়কর অধ্যাদেশে জাল টিআইএন ব্যবহারের জন্য ব্যবহারকারীর ওপর আর্থিক জরিমানাসহ কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। ১২৪-এ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি অন্যের টিআইএন অথবা জাল টিআইএন ব্যবহার করেন বা আয়কর আইন অনুযায়ী যেসব ক্ষেত্রে টিআইএন ব্যবহার বাধ্যতামূলক, সেসব ক্ষেত্রে জাল টিআইএন ব্যবহার করলে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা জরিমানা আরোপের বিধান রয়েছে। অন্যদিকে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সেবা দেওয়ার সময় টিআইএন ভেরিফিকেশন না করলেও ওই প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা আরোপের বিধান রয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশের ১২৪-এ ধারা অনুযায়ী সেবা প্রদানকালে টিআইএন সনদ যাচাই না করলে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে আয়কর বিভাগ। ১৬৫-এ ধারা অনুযায়ী, ইচ্ছাকৃতভাবে যদি কোনো ব্যক্তি জাল টিআইএন ব্যবহার করেন বা অন্যের টিআইএন ব্যবহার করেন, সেক্ষেত্রে ব্যবহারকারীকে সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।
কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চল কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান শেয়ার বিজকে বলেন, নিবন্ধন আর ফিটনেস নবায়নে ই-টিআইএন যাচাই হলে করফাঁকি বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা তথ্য নিয়ে যাচাই করে গাড়ি মালিককে করের আওতায় আনতে পারব। ঈদের পর কমিটির সভায় বিস্তারিত আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।