নজরুল ইসলাম; রাজধানী ঢাকার কলাবাগান, নিউ ইস্কাটন, আদাবর ও মিরপুরের সেনপাড়ায় ফ্ল্যাট ও বহুতল ভবন। বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের পাতারহাটে ১৭টি দলিলে ৫২৭.৭৫ শতাংশ জমি। পাতারহাটে ১ হাজার ২০০ বর্গফুটের দুই তলাবিশিষ্ট ভবন। এসব সম্পদের পাহাড় গড়েছেন গালফ সিকিউরিটিজ সার্ভিসেস (প্রা.) লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও বর্তমানে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আবু বকর সিদ্দিক স্বপন ওরফে এবিএস খান স্বপন। তার সাত কোটি ৩ লাখ ৭৬ হাজার ২৬৯ টাকা মূল্যের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। উপসহকারী পরিচালক এসএম আনিসুজ্জামান তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছেন।
এছাড়া ঢাকার সাভারে নির্মাণাধীন বহুতল ভবন ও সেখানে ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং কানাডায় বাড়ি ও ছেলেমেয়েরা সেখানে লেখাপড়া করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
দুদকের এজাহার ও অনুসন্ধান প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, সরকারি-বেসরকারি ৫৯টি প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী স্বপনের নামে স্থাবর সম্পদের পাহাড় পাওয়া গেছে। এসবের মধ্যে ঢাকার ধানমন্ডির ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের কলাবাগানের ১৫৬ লেক সার্কাস এলাকায় ৭৫ অযুতাংশ জমি ও ১ হাজার ৭০১ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, রমনার নিউ ইস্কাটনের কাকরাইল মৌজায় ৬৪০ অযুতাংশ জমি ও ৫ তলা ভবন, আদাবরের সুনিবিড় হাউজিং সোসাইটিতে (৭৩/সি) ৭.৪২ শতাংশ জমিসহ ৭ তলা ভবন ও মিরপুরের সেনপাড়া মৌজায় কার পার্কিংসহ ৭ তলা ভবন। ২০১২-২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ে ১৭টি দলিলে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের পাতারহাটে ৫২৭.৭৫ শতাংশ জমি কিনেছেন। এছাড়া পাতারহাটে ১ হাজার ২০০ বর্গফুটের ২ তলাবিশিষ্ট একটি বিল্ডিং পাওয়া গেছে। এসব স্থাবর সম্পদের মূল্য ৯ কোটি ৪০ লাখ ১১ হাজার টাকা।
তার ৯ কোটি ৪০ লাখ ১১ হাজার টাকার স্থাবর ও ১ কোটি ১২ লাখ ৮০ হাজার ২৯ টাকার অস্থাবর সম্পদসহ মোট ১০ কোটি ৫২ লাখ ৯১ হাজার ২৯ টাকার সম্পদ পেয়েছে দুদক। তার ঋণের স্থিতির পরিমাণ ২ কোটি ১৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ঋণ ছাড়া নিট সম্পদ ৮ কোটি ৩৭ লাখ ২১ হাজার ২৯ টাকা। আয়কর নথিতে ৩ কোটি ৭৪ লাখ ৫৪ হাজার ৯৫ টাকার আয় ও ২৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার ব্যয় দেখিয়েছেন। আয়কর নথি ও অন্যান্য রেকর্ডপত্র অনুযায়ী, ২০১৯-২০২০ করবর্ষ থেকে ২০২১-২০২২ করবর্ষ পর্যন্ত সময়ে তার আগের সঞ্চয় ৩৫ লাখ ৯৩ হাজার ৯৫ টাকা, সম্মানী ১২ লাখ, গৃহসম্পত্তির আয় ১৮ লাখ, কৃষি থেকে ৪ লাখ ৮০ হাজার, ব্যবসায় থেকে ২৮ লাখ ৩০ হাজার, করমুক্ত আয় ৩৩ লাখ ৮ হাজার, ফ্ল্যাট বিক্রি থেকে ২৬ লাখ ৭৩ হাজার, ব্যাংকঋণ ২ কোটি ১৫ লাখ ৫৯ হাজার ৩৩৫ টাকা ও বিবিধ আয় ১০ হাজার ৬৬৫ টাকাসহ মোট ৩ কোটি ৭৪ লাখ ৫৪ হাজার ৯৫ টাকা দেখিয়েছেন তিনি। ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ অপরিশোধিত রয়েছে। অনুসন্ধান প্রতিবেদনে ঋণ ছাড়া নিট সম্পদ বিবেচনা করা হয়েছে, তাই এই ঋণের টাকা সম্পদ অর্জনে আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। সেই হিসাবে দায় ছাড়া তার গ্রহণযোগ্য আয় দাঁড়ায় ১ কোটি ৫৮ লাখ ৯৪ হাজার ৭৬০ টাকা। আয়কর নথি অনুযায়ী পারিবারিক ব্যয় ২৫ লাখ ৫০ হাজার টাক। ব্যয়সহ নিট সম্পদ ৮ কোটি ৬২ লাখ ৭১ হাজার ২৯ টাকা। সেই হিসাবে গ্রহণযোগ্য আয়ের চেয়ে সম্পদ বেশি পাওয়া গেছে ৭ কোটি ৩ লাখ ৭৬ হাজার ২৬৯ টাকা, যা তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ। এসব অর্জন ও দখলে রেখে তিনি দুদক আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছেন, ১৯৮৮ সালে তিনি এসএসসি পাস করেছেন। এখন বাউবিতে অধ্যয়নরত। ১৯৯৯ সালে গালফ সিকিউরিটিজ সার্ভিসেস (প্রা.) লিমিটেডের ৫ হাজার শেয়ারের মধ্যে ২ হাজার শেয়ার কেনেন। তার পূর্ব-অভিজ্ঞতার কারণে কর্তৃপক্ষ তাকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব দেয়। তিনি ২০২০ সাল পর্যন্ত সেই দায়িত্ব পালন করেন। এখন তার স্ত্রী অনামিকা সামাদ এমডির দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে মাসিক ১ লাখ ২০ হাজার টাকা বেতনে কর্মরত রয়েছেন। এছাড়া তিনি মাইক্রোম্যাক্স ডেভেলপারস লিমিটেডের ব্যবস্থাপানা পরিচালক। তিনি ১৯৯৬ সালে রোকসানা শাহনাজকে বিয়ে করেন। ১৯৯৮ সালে তার সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে যায়। ১৯৯৯ সালে অনামিকা সামাদকে বিয়ে করেন। তার এক মেয়ে ও দুই ছেলে। তারা সবাই লেখাপড়া করছে। তিনি রাজধানীর ধানমন্ডির কলাবাগানে বসবাস করেন। গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলায়।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, তদন্তে আর কারও সংশ্লিষ্টতা ও নতুন সম্পদের তথ্য পাওয়া গেলে সেসবও আমলে নেয়া হবে।
অভিযোগের বিষয়ে আবু বকর সিদ্দিক স্বপন ওরফে এবিএস খান স্বপন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘দুদক আইনের ২৬(১) ধারা অনুযায়ী সম্পদ বিবরণী চাওয়ার কথা কিন্তু টাকা-পয়সা খাওয়ার জন্য কর্মকর্তা ভুলভাল হিসাব দেখিয়েছেন। আমি কমিশনার (তদন্ত) স্যারের সঙ্গে দেখা করেছি। আমাদের ট্যাক্সফাইলসহ সব আপ-টু-ডেট। আমাদের বাড়িও ব্যাংকের নামে। আমরা তো বাড়ি কেনাবেচা করি। কিনে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ইনোভেশন করে বিক্রি করি। লোন একটা দেখিয়েছে, তিনটা দেখায়নি। আমাদের অভিযোগের ভিত্তিতে আইও (তদন্ত কর্মকর্তা) পরিবর্তনও করে দিয়েছে দুদক। উনি (অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা) তো মামলার জন্য সুপারিশ করেননি। সম্পদ বিবরণীর জন্য সুপারিশ করেছিলেন।’
সব স্থাবর সম্পদ আপনার নিজের কেনা কিনাÑজানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সব সম্পদ আমার কেনা নয়। একটা দলিলের মধ্যে তিনজনের নামও আছে, উনি সব সম্পদ আমার নামে দেখিয়েছেন।’
গালফ সিকিউরিটিজ সার্ভিসেসে কত সাল থেকে এমডি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেনÑএই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘১৯৯৯ সাল থেকে। এটা আমার একার প্রতিষ্ঠান নয়, শেয়ারহোল্ডারভিত্তিক।’
সাভারে নির্মাণাধীন ভবন ও সেখানে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হিসাবের বাইরে কিছু পেলে তার দশগুণ আমি দিয়ে দেব।’
অভিযোগ রয়েছে, আপনার দুই ছেলে ও এক মেয়ে কানাডায় লেখাপড়া করে, সেখানে আপনার বাড়িও রয়েছে। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এসব উদ্ভট তথ্য। আমি যতটুকু তথ্য দুদকে দিয়েছি, তার চেয়ে যদি এক ইঞ্চি বেশি পান; দশ ইঞ্চি আমি দিয়ে দেব। দুদকের ক্লিনিং সার্ভিসটাও আমার। টেন্ডারে কাজ না পেয়ে আমার বিরুদ্ধে ভুয়া অভিযোগ দিয়েছে।’
উল্লেখ্য, ২০২০ সালে চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দুজনকে জাল নিয়োগপত্র দেয়ার অভিযোগে গালফ সিকিউরিটিজ সার্ভিসের ক্যাশিয়ারসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আদালতে দুটি মামলা হয়। আসামিরা হলোÑক্যাশিয়ার ইমরান হোসেন মামুন, ফরিদপুরের খোরদো খালেক বাজার এলাকার আনোয়ার হোসেনের ছেলে সংস্থার মাঠকর্মী সাহেদ হোসেন সাঈদ এবং ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হালিধানী গ্রামের বাসিন্দা সংস্থার মাঠকর্মী শমসের আলী। ওই বছরের ২৮ ডিসেম্বর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাইফুদ্দীন হোসাইন মামলা দুটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) যশোরকে নির্দেশ দেন। যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল এলাকার আবদুর রহমান এবং সদর উপজেলার কামারগন্না গ্রামের অহিদুজ্জামান মামলা দুটি দায়ের করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সেই মামলায় আমরা খালাস পেয়েছি। এগুলো ভুয়া মামলা।’
দুদক সূত্র জানিয়েছে, সহকারী পরিচালক তাজুল ইসলাম ভুঁইয়াকে মামলাটির তদন্তকারী নিয়োগ করা হয়েছে।